শয্যাসংকট, মেঝেতে চিকিৎসা 

শয্যাসংকটের পাশাপাশি চিকিৎসকসংকট। ৩৬ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১২ জন।

পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে শয্যাসংকটে রোগীদের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি হাসপাতালের পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ডে।ছবি: প্রথম আলো

বমি ও পেটব্যথায় অসুস্থ ছেলে মাহিম ইসলামকে (৮) নিয়ে সম্প্রতি পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসাপাতালে ভর্তি করেছেন মা নাজমিন বেগম। হাসাপাতালে শয্যা না থাকায় বারান্দার মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মাহিমকে। অতিরিক্ত রোগীর চাপে বারান্দার মেঝেতে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে অনেক রোগীকে। পাশাপাশি পাশ দিয়ে মানুষ চলাচলের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ওই সব রোগী ও স্বজনকে।

শুধু নাজমিন বেগমই নন। শয্যাসংকটে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা প্রায় অধিকাংশ রোগীকে মেঝে আর বারান্দায় থেকে চিকিৎসা নিতে এমন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। শয্যাসংকটের পাশাপাশি চিকিৎসকসংকট ও পর্যাপ্ত চিকিৎসাব্যবস্থা না থাকায় বেশির ভাগ জরুরি রোগীকেই পাঠানো হচ্ছে রংপুর ও দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অথচ পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে নির্মাণকাজ চলা হাসপাতালের ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের ভবনটি এখনো হস্তান্তর করা হয়নি। ভবন নির্মাণের দায়িত্বে থাকা গণপূর্ত বিভাগ বলছে কাজ শেষ; কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনো কিছু কাজ বাকি আছে। 

সম্প্রতি এক দুপুরে পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নতুন করে নির্মাণের পর রং করা ভবনটি পড়ে আছে। 

জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্থাপিত হাসপাতালটিতে প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় ৫০০ রোগী সেবা নিয়ে থাকে। আর আন্তবিভাগে ভর্তি থাকে ২০০ থেকে ২৮৬ জন। ১০০ শয্যা হওয়ায় প্রায় সব সময়ই ১০০ থেকে ১৮০ জন রোগীকে মেঝেতে রেখে চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খেতে হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। সম্প্রতি একদিন দুপুরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাসপাতালের বহির্বিভাগে শিশু, নারী ও পুরুষ মিলে মোট চিকিৎসা নিয়েছেন ৬০৬ জন এবং ২২৭ জন রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

হাসপাতালে এত রোগীর চাপ ওয়ার্ডে কোনো সিট নেই। এ জন্য বারান্দায় যাতায়াতের পথে শুইয়ে রেখেই বাবাকে স্যালাইন দিতে হচ্ছে।
মমিনুল ইসলাম, এক রোগীর স্বজন

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ষাটের দশকে পঞ্চগড় মহকুমায় ক্ষুদ্র পরিসরে নির্মিত হয় পঞ্চগড় স্বাস্থ্যকেন্দ্র। ১৯৮৪ সালে পঞ্চগড় ‘জেলা’ ঘোষণার পর স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়ে পরিণত হয় পঞ্চগড় সদর হাসপাতালে। ২০০৫ সালে হাসপাতালটি ১০০ শয্যায় উন্নীত হয়ে পরিণত হয় আধুনিক সদর হাসপাতালে। এরপর থেকেই শুরু হওয়া চিকিৎসকসহ প্রয়োজনীয় জনবল সংকট, যা আজও ঘোচেনি। বর্তমানে হাসপাতালটিতে ৩৬ জন চিকিৎসকের বিপরীতে কর্মরত আছেন ১২ জন। 

পঞ্চগড় গণপূর্ত বিভাগের আওতায় ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হয় পঞ্চগড় আধুনিক সদর হাসপাতালটিকে ১০০ শয্যা থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণের কাজ। প্রায় ৫৭ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ে নতুন করে ১৫০ শয্যার হাসপাতাল তৈরিতে কাজ করছে মোট ছয়টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে প্রায় সব কাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি গণপূর্ত বিভাগের। 

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে মূল ভবন তৈরি ও বহিঃপানি সরবরাহ নির্মাণ কাজ করেছে ঢাকার মার্ক বিল্ডার্স লিমিটেড, বহির্বিদ্যুৎ–সংযোগ স্থাপনের কাজ করেছে রংপুরের সৈয়দ সাজ্জাদ আলী এন্টারপ্রাইজ, মেডিকেল গ্যাস স্থাপনের কাজ করেছে ঢাকার স্পেকট্রা লিমিটেড, সার্ভিস বিল্ডিং নির্মাণের কাজ করেছে পঞ্চগড়ের শেখ ট্রেডার্স এবং লিফট স্থাপনের কাজ করেছে ঢাকার সুপারস্টার লিমিটেড। 

গণপূর্ত বিভাগ জানায়, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে শুরু হওয়া হাসপাতালের মূল ভবন নির্মাণের কাজের মেয়াদ শেষ হয় ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে। এরপর ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। করোনাকালে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকায় সময় বাড়ে হয়েছে। এরই মধ্যে মূল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে বলে দাবি গণপূর্ত বিভাগের। তবে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, পানি সরবরাহ, মেডিকেল গ্যাস, লিফট ও সার্ভিস বিল্ডিংসহ অন্যান্য কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় হাসপাতাল ভবনটি সময়মতো হস্তান্তর করা সম্ভব হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্মাণকাজ শেষ করে বুঝে নেওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয় গণপূর্ত বিভাগ। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি মনিটরিং কমিটি করে। ওই কমিটি ভবন পরিদর্শন করে কিছু কাজের চাহিদাও দেয়। সেই অনুয়ায়ী কাজ করে দেওয়া হয়েছে বলে দাবি গণপূর্ত বিভাগের। এখন যেকোনো সময় ভবনটি বুঝে দিতে প্রস্তুত বলে দাবি করছে গণপূর্ত বিভাগ। 

২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণে নতুন ভবন নির্মাণে কিছু কাজ বাকি থাকায় ভবনটি এখনও বুঝে নেওয়া যায়নি বলে জানান পঞ্চগড়ের সিভিল সার্জন মোস্তফা জামান চৌধুরী। আর পঞ্চগড় গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান সরকার জানান, হাসপাতাল ভবন নির্মাণের কাজ চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই শেষ করা হয়েছে। এরপর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে ভবন বুঝে নিতে চিঠিও দেওয়া হয়েছে। পরে তাঁরা একটি মনিটরিং কমিটি করে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং কিছু কাজের চাহিদা দিয়েছিলেন। সেগুলো সম্পন্ন করা হয়েছে। এখন ভবনটি হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে। 

সদর উপজেলার ধাক্কামারা ইউনিয়নের শিকারপুর এলাকার মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা সুলতান আলী হঠাৎ করেই বমি ও মাথা ঘোরার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে আসি। হাসপাতালে এত রোগীর চাপ ওয়ার্ডে কোনো সিট নেই। এ জন্য বারান্দায় যাতায়াতের পথে শুইয়ে রেখেই বাবাকে স্যালাইন দিতে হচ্ছে। নতুন একটা বিল্ডিং হইচে, কিন্তু কই ওইটাতো চালু হয় না।’