চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের ৮৮ ভাগ ‘ডেন–২’ ধরনে আক্রান্ত
চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের এবার ৮৮ ভাগই ‘ডেন–২’ ধরনে আক্রান্ত হচ্ছে। গত বছর ৬৬ ভাগ রোগী ছিল ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত। এ ছাড়া গত বছরের অর্ধেক রোগীর জিনোম সিকোয়েন্সে ডেন-২–এর আরেকটি উপধরন কসমোপলিটন লিনিয়েজের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ডেন-২–এর উপধরন কসমোপলিটন লিনিয়েজের কারণে ডেঙ্গু রোগী দ্রুত খারাপ হওয়ার পাশাপাশি এতে মৃত্যুর শঙ্কাও বেশি বলে গবেষক ও চিকিৎসকেরা জানান।
চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে চলমান গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে চলমান এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আইসিডিডিআরবি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ। গত বছর ১ হাজার ৫০০ রোগী এবং এবার ২০০ রোগীর ওপর এ পর্যন্ত জরিপ গবেষণা চালানো হয়েছে।
যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, চট্টগ্রামে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৮৮ ভাগ রোগীর মধ্যেই পাওয়া গেছে ডেন-২ ধরন। ১১ ভাগ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে ডেন-৩ ধরন।
২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬৯ ভাগ রোগীই ডেন–২ সেরোটাইপে আক্রান্ত ছিল। গত বছরের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্স করে দেখা গেছে, ৫০ ভাগ রোগীর মধ্যে ডেন-২–এর উপধরন কসমোপলিটন উপস্থিত, যা রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বাড়িয়ে দেয় বলে চিকিৎসক ও গবেষকেরা মনে করছেন। কসমোপলিটন ভেরিয়েন্টের কারণেই চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার বৃদ্ধি ও মৃত্যু বেশি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই বছরের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকোয়েন্স করার পর কসমোপলিটন লিনিয়েজ ধরন রয়েছে কি না, বলা যাবে বলে মনে করছেন গবেষক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান। তিনি বলেন, কসমোপলিটন লিনিয়েজ বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। এ কারণে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়। বাংলাদেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে পাওয়া আগের ধরনগুলোর চেয়ে চট্টগ্রামে পাওয়া কসমোপলিটন ধরনটি ভিন্ন। ফাইলোজেনেটিক বিন্যাস তথা তুলনামূলক বিশ্লেষণে পাওয়া যায় ডেন-২–এর উপ এই ধরন মিয়ানমার এবং ভারতে বিদ্যমান। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ও পর্যটকদের মাধ্যমে তা এখানে আসতে পারে।
গত বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ছিল পুরুষ। ডেঙ্গু রোগীদের প্রতি পাঁচজনে একজন ছিল শিশু। এ ছাড়া চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি এলাকাকে হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ৬০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থল পাঁচটি এলাকায়। এলাকাগুলো হলো বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালি, ডবলমুরিং এবং বায়েজিদ বোস্তামী। এ ছাড়া গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া, বোয়ালখালী এবং কর্ণফুলী এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে।
এ বছর চলতি মাস পর্যন্ত ২০০ রোগীর তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী এবার ২ হাজার ৩৩৩ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছে ২০ জন। সব৴শেষ গতকাল নূর উদ্দিন নামে এক যুবক মারা যান। এবার নগরের কোতোয়ালি ও বাকলিয়া এলাকায় ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া গেছে।
গত বছর মোট ১৪ হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছিল। তখন ১০৭ জন মারা গিয়েছিল।
এবার আরও রোগীর নমুনা নিয়ে জিনোম সিকোয়েন্স করা হবে বলে গবেষকেরা জানান। জিনোম সিকোয়েন্সগুলো জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটার (জিআইএসএআইডি)–এ গৃহীত হয়েছে। এ ছাড়া দুটি গবেষণাপত্র ইতিমধ্যে ইউরোপিয়ান জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনোলজি এবং আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন–এ গৃহীত হয়েছে।
আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই গবেষণা দলে আছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আবদুস সাত্তার ও আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক আদনান মান্নান এবং এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুর রব।
আবদুর রব বলেন, ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান ও নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণের জন্য জিনোম সিকোয়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব তথ্য পরবর্তী সময়ে ডেঙ্গু প্রতিরোধে ভূমিকা রাখবে।