সাগরে ধরা পড়ছে ইলিশ, জেলে ও ব্যবসায়ীদের স্বস্তি 

গত সোমবার থেকে সাগরে বেশি ইলিশ ধরা পড়ছে। এতে বাজারে ইলিশের দাম কমছে। তবে নদীতে এখনো ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য বন্দর বরগুনার পাথরঘাটা বিএফডিসি মৎস্য অবতরণ কেন্দ্রে সাগরে ধরা পড়া ইলিশ। গত বুধবার তোলা ছবি
প্রথম আলো

দক্ষিণের জেলেদের আশা ছিল, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাবে। কিন্তু ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা এক সপ্তাহ আগে শেষ হলেও নদ-নদী ও সাগরে তেমন ইলিশ ধরা পড়ছিল না। এতে লাখো জেলে-ব্যবসায়ী হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। এ অঞ্চলের মৎস্য অবতরণকেন্দ্রগুলো মাছের অভাবে খাঁ খাঁ করছিল। কিন্তু গত সোমবার থেকে সাগরে জালে ইলিশ ধরা পড়ায় সমুদ্রগামী জেলেদের হতাশা কিছুটা কমেছে। 

সাগর-নদীতে ইলিশের আকালের পরিপ্রেক্ষিতে ইলিশ–বিশেষজ্ঞরা আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, আগস্টের প্রথম দিকে শুরু হবে ইলিশের মৌসুম। এ সময় থেকে নদী-সাগরে ইলিশের দেখা পাওয়া যাবে। বরগুনার পাথরঘাটায় অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্য বন্দর বিএফডিসি মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে গত মঙ্গলবার এক দিনেই ৫২৫ মণ ইলিশ এসেছে। এর আগের দিন এসেছিল ২৭৯ মণ। 

পাথরঘাটা চরদুয়ানী এলাকার ট্রলারমালিক সোহরাফ হোসেন মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মালিকানাধীন ট্রলারটি প্রায় আড়াই লাখ টাকা ব্যয় করে গত শনিবার রাতে সাগরে মাছ ধরার উদ্দেশ্যে রওনা করেছিল। এখানে সাগরে থাকার জন্য ১০ দিনের রসদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বৈরী আবহাওয়ার কারণে তিন দিনেই মাঝিমাল্লারা ট্রলার নিয়ে ঘাটে ফিরেছেন। এই তিন দিনে দুই হাজার মণ ইলিশ এবং অন্য আরও বেশ কিছু মাছ পেয়েছেন। এতে দেড় লাখ টাকার ইলিশ এবং অন্য মাছ বিক্রি করেছেন ৭৫ হাজার টাকায়। সাত দিনের বাজার-সদাই, জ্বালানি ও বরফ বেঁচে যাওয়ায় মোটামুটি ভালো লাভ হবে। সোহরাফ হোসেন বলেন, ‌‘এ বছর যে রকম মাছের আকাল ছিল, যা পেয়েছি, তাতেই খুশি। আশা করি, সামনে আরও বেশি মাছ পাওয়া যাবে।’

পাথরঘাটার মোকামে ইলিশের আমদানি বাড়ায় দামও কিছুটা কমেছে। প্রতি মণ ইলিশের দাম কমেছে অন্তত পাঁচ হাজার টাকা। ৬০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকায়। আগে তা ছিল ৫২ থেক ৫৫ হাজার টাকা। আর এক কেজি ওজনের ওপরে আগে ইলিশের পাইকারি দাম ছিল প্রতি মণ ৬৫ থেক ৭০ হাজার টাকা। এখন ওই ওজনের ইলিশের দাম কমে হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা।

নদ-নদীতে ইলিশ ধরা না পড়ায় বরিশালের প্রধান পাইকারি মোকাম পোর্ট রোডে এখনো কর্মব্যস্ততা বাড়েনি। ব্যবসায়ীরা এতে হতাশা প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার এই মোকামে ১৫ থেকে ২০ মণ ইলিশের আমদানি হয়েছে। অথচ এই সময়ে প্রতিদিন এক হাজার মণের বেশি ইলিশ আসার কথা। এতে দামে কোনো হেরফের হয়নি। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০০৭ সালের পর দেশের ঋতুগুলোতে বেশ পরিবর্তন আসায় এখন বর্ষা মৌসুম আগস্ট-সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবরে চলে গেছে। যেহেতু ইলিশের উৎপাদন ও প্রজনন আবর্তিত হয় বর্ষা ও নদীর উঁচু জোয়ার ও স্রোত ঘিরে, তাই ইলিশের মৌসুমও পিছিয়ে গেছে। আর ভালো ব্যবস্থাপনার কারণে এখন শীতেও ব্যাপক ইলিশ মিলছে। ফলে শীতে ইলিশের বর্ধিত একটি মৌসুম পরিলক্ষিত হচ্ছে।

চাঁদপুরে অবস্থিত মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আগেই বলেছিলাম আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকে ইলিশ আসবে।  কারণ, এখন জুন-জুলাই নয়; মূলত সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসকে ইলিশের মূল মৌসুম ধরা হয়। আগস্ট থেকে বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়ার গতি বেড়ে গেলে মূলত ইলিশ উপকূলে ধেয়ে আসে। তাই এখন আগস্টের আগে ইলিশ পাওয়া যায় না। দু-তিন দিনের মধ্যে পূর্ণিমায় আরও বেশি ইলিশ ধরা পড়বে। এর মধ্য দিয়ে ইলিশের মূল মৌসুমের সূচনা হবে।

নদীতে ইলিশ না আসার বিষয়ে আনিসুর রহমান বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে আমাদের বর্ষা মৌসুমে এখন হেরফের হচ্ছে। ইলিশের প্রজনন, উৎপাদনেও তাই হেরফের হচ্ছে। বৃষ্টি, নদীতে স্রোত ও পানির চাপের সঙ্গে ইলিশের প্রজনন-উৎপাদনের সম্পর্ক রয়েছে। একই সঙ্গে পদ্মা-মেঘনাসহ উপকূলের নদ-নদীতে প্রচুর অবৈধ জাল, ডুবোচর ও দূষণের কারণে নদ-নদীতে ইলিশ আসতে বাধা পাচ্ছে। এরপরও কিছুদিনের মধ্যে এসব বাধা পার হয়ে নদ-নদীতে ইলশি আসবে বলে আমরা আশাবাদী।’