২০ সেকেন্ডে সব জেলার নাম বলতে পারেন ‘প্রচারম্যান’ আয়ুব আলী

মোটরসাইকেলে চড়ে মাইকিং করছেন আয়ুব আলী সানা। গত বুধবার দুপুরে খুলনার দাকোপ উপজেলার কামারখোলা এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ সড়কেছবি: প্রথম আলো

‘একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি, একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি। শিবনগর গ্রাম নিবাসী…একটি মানিব্যাগ হারিয়ে গেছে। মানিব্যাগে সামান্য টাকা থাকলেও তাতে এনআইডি কার্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র রয়েছে। কোনো হৃদয়বান ব্যক্তি যদি মানিব্যাগটি পেয়ে থাকেন, তাহলে কালিনগর বাজার মোটরসাইকেল চালক সমবায় সমিতির অফিস বা কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে ফেরত দেওয়ার অনুরোধ করা হলো। তাঁকে অবশ্যই পুরস্কৃত করা হবে।’

মোটরসাইকেলে বসে জ্যাকেটের সঙ্গে লাগানো ছোট মাইক্রোফোনের সাহায্যে ঘোষণাটি দিচ্ছিলেন আয়ুব আলী সানা। ধুলা ওড়া মাটির রাস্তায় ধীরে চলছিল আয়ুবের মোটরসাইকেল। বিভিন্ন মোড়ের কাছে মোটরসাইকেল পুরোটা থামিয়ে বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে ওই হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রচার করছিলেন।

খুলনার দাকোপ উপজেলার কোথাও জনসভা, সমাবেশ, উপজেলা প্রশাসনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তি, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কোনো ঘোষণা, কোথাও ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রচারের দরকার পড়লেই ডাক পড়ে আয়ুবের। ৪২ বছর বয়সী আয়ুব ১০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করে আসছেন ‘মাইকিংশিল্পী’ হিসেবে। এটাই এখন তাঁর অন্যতম পেশা। আয়ুবের অন্য একটি পেশাও আছে। মোটরসাইকেলে ভাড়ার বিনিময়ে যাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। কালিনগর বাজার মোটরসাইকেল চালক সমবায় সমিতির প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক আয়ুব।

গত বুধবার দুপুরে আয়ুব আলী সানার সঙ্গে দেখা হয় কামারখোলা গ্রামের রাস্তায়। তাঁর সঙ্গে থাকা মাইকের ভেতরের দিকে লেখা—‘প্রচারম্যান: আয়ুব আলী ভাই’। সঙ্গে তাঁর মুঠোফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে।

আলাপে আলাপে জানা গেল, আয়ুব আলীর বাড়ি দাকোপের কামারখোলা ইউনিয়নের সাহারাবাদ গ্রামে। তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে নিজের বাড়িতেই থাকেন। আয়ুবের বয়স যখন ছয় থেকে সাত বছর, তখন বাবা মারা যান। ক্লাস সিক্সের পর পড়ালেখাটা তাই আর বেশি দূর এগোয়নি। কৈশোর পেরোনোর আগেই পেশা হিসেবে বেছে নেন মোটরসাইকেলে করে যাত্রী পরিবহনের।

আয়ুব আলীর বাড়ি দাকোপের কামারখোলা ইউনিয়নের সাহারাবাদ গ্রামে। তিন সদস্যের পরিবার নিয়ে নিজের বাড়িতেই থাকেন। ক্লাস সিক্সের পর পড়ালেখাটা আর বেশি দূর এগোয়নি।

আয়ুব আলী বলেন, ‘বয়স যখন ১৬-১৭, তখন মোটরসাইকেল কিনে রাস্তায় নামি। দাকোপের রাস্তাঘাট আর যোগাযোগব্যবস্থা খুব খারাপ থাকায় মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহন তখন কেবল শুরু হচ্ছিল। তখন মোটরসাইকেলের সংখ্যা কম ছিল, চাহিদা ছিল অনেক বেশি। উপজেলার বিভিন্ন প্রান্তে মোটরসাইকেলে করে যাত্রী নিয়ে যেতাম। বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, কয়রা, যশোর এমনকি বরিশাল অঞ্চলেও আমরা যাত্রী নিয়ে যেতাম। ভাড়া টেনে মাসে তখন খুব সহজেই ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা রোজগার হতো।’

মোটরসাইকেলে যাত্রী বহন করে ভালোই কাটছিল আয়ুবের দিন। তবে সেই সুখের সুতো কেটে যায় ঘূর্ণিঝড় আইলায়। ২০০৯ সালের মে মাসে আইলার জলোচ্ছ্বাসে দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে লোনাপানিতে তলিয়ে যায় আয়ুবদের এলাকা। বেড়িবাঁধের ঢালে আশ্রয় নিতে হয় আয়ুবসহ জনপদের হাজারো মানুষকে। মোটরসাইকেলটি বিক্রি করে দেন আয়ুব আলী।

শুকনা মৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই আয়ুব আলীর হাতে প্রচারণার কাজ থাকে। যেদিন কাজ থাকে না; সেদিন মোটরসাইকেলে যাত্রী টানেন
ছবি: প্রথম আলো

পেশা হারিয়ে দিশাহারা আয়ুবের ‘প্রচারম্যান’ হওয়ার পেছনেও ওই ‘আইলা’। আয়ুব আলী জানান, আইলার পর ভেঙে যাওয়া বাঁধের বিভিন্ন অংশে এলাকার মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতেন। বিভিন্ন এনজিও, সংগঠনও এসব কাজ করত। খুলনায় বসবাসরত পারজয়নগর গ্রামের একজন ব্যবসায়ী এলাকায় বাঁধ বাঁধতে আসেন। তিনি হ্যান্ডমাইক নিয়ে আসেন। সেখানে কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আয়ুব ওই হ্যান্ডমাইকেই নানা রকম নির্দেশনা দেন। ওই ব্যবসায়ী তাঁকে খুলনা শহরে নিয়ে যান। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে মুঠোফোন সংযোগের সিম কার্ড বিক্রির কাজে লাগিয়ে দেন। ওই ব্যবসায়ীর ঠিকাদারি প্রকল্পেও বছর দুয়েক কাজ করে ২০১৪ সালের দিকে আবার নিজ এলাকায় ফেরেন আয়ুব আলী। কিনে ফেলেন মোটরসাইকেল আর হ্যান্ডমাইক।

আয়ুব আলী বলেন, ‘গ্রামে ফিরে মোটরসাইকেলে ভাড়া টানার পাশাপাশি অল্পপরিসরে বিভিন্ন প্রচারণার কাজে যুক্ত হই। পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির (সিপিপি) একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দুর্যোগ চলাকালীন ও আগমুহূর্তে মাইকিং করে সচেতনতা তৈরির কাজ করি। এতে পরিচিতি আরও বাড়তে থাকে। বাইকের চেয়ে মাইকেই বেশি আয় হচ্ছে। এখন প্রচারণার পাশাপাশি সমাবেশ সঞ্চালনা, অনুষ্ঠান উপস্থাপনার কাজেও ডাক পাচ্ছি। তবে সরকার পরিবর্তনের পর দলীয় প্রচারের কাজে ভাটা পড়েছে।’

তিন ঘণ্টা সময় ধরে প্রচারণার জন্য আয়ুব আলী নেন এক হাজার টাকা। এটা তার নিজের ইউনিয়নের জন্য। অন্য ইউনিয়নে এটা বেড়ে ১ হাজার ৫০০ পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল, মাইক, খেয়াপারাপার সব খরচা তাঁর।

তিন ঘণ্টা সময় ধরে প্রচারণার জন্য আয়ুব আলী নেন এক হাজার টাকা। এটা তার নিজের ইউনিয়নের জন্য। অন্য ইউনিয়নে এটা বেড়ে ১ হাজার ৫০০ পর্যন্ত হয়। এর মধ্যে মোটরসাইকেল, মাইক, খেয়াপারাপার সব খরচা তাঁর। প্রার্থীর সঙ্গে চুক্তিতে নির্বাচনী প্রচারণায়ও যান আয়ুব। শুকনা সৌসুমে প্রায় প্রতিদিনই আয়ুবের হাতে প্রচারণার কাজ থাকে। যেদিন কাজ থাকে না সেদিন মোটরসাইকেলে যাত্রী টানেন।
আয়ুব আলী বলেন, ‘আনন্দ নিয়ে কাজটা করি। কোনো একটা অনুষ্ঠানে আমি ভালো দর্শক এনে দিতে পারি, এটাই আনন্দ। আর জনপ্রতিনিধি, সরকারি কর্মকর্তা, এনজিওর বড় কর্মকর্তা, এলাকার ছোট-বড় সবাই আমাকে চেনেন। আমার কণ্ঠ চেনেন। দল–মত–জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে সবার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। সবার ভালোবাসা পাই। নানাভাবে সম্মান করে, আপ্যায়ন করে।’

আয়ুব আলীর সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বিভিন্ন ছন্দে ছন্দে কথা বলছিলেন। কথার ফাঁকে ২০ সেকেন্ডে ৬৪ জেলার নাম শুনিয়ে দেন। প্রাপ্তি আর তৃপ্তির বিষয়ে তিনি ছন্দে ছন্দে বলেন, ‘যে ভালোবাসা পাই, তা কী করে বুঝাই। সুন্দরবনে থাকে রয়েল বেঙ্গল বাঘ, আপ্যায়ন না গ্রহণ করলে তারা করে রাগ।’