পাঁচ মাস ধরে বন্ধ থাকা খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) দ্রুত খুলে ক্লাস-পরীক্ষা শুরুর দাবিতে মানববন্ধন করেছেন অভিভাবকেরা। আজ রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে ‘কুয়েট গার্ডিয়ান ফোরাম’ এ কর্মসূচির আয়োজন করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা অভিভাবকেরা মানববন্ধনে অংশ নেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, দীর্ঘদিন কুয়েট বন্ধ থাকায় ৫ হাজার শিক্ষার্থী এবং তাঁদের পরিবার মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা চাকরি ও বিদেশি শিক্ষাবৃত্তির সুযোগ হারাচ্ছেন। এ অবস্থায় সরকার, শিক্ষক ও প্রশাসনের উদ্যোগহীনতা দুঃখজনক।
মানববন্ধনে একজন অভিভাবক হিসেবে খুলনা মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ফররুখ আহমেদ বলেন, ‘একটা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় আজ পাঁচ মাস ধরে বন্ধ। এখানকার ৫ হাজার শিক্ষার্থী ও ১০ হাজার অভিভাবক এটার জন্য ভোগান্তিতে পড়েছেন। দেশের যতগুলো কর্তৃপক্ষ, কারও যেন কোনো মাথাব্যথা নেই। কুয়েটের শিক্ষার্থীরা সবাই ক্লাস চান, তাহলে চান না কারা? শিক্ষকেরা যদি যথাযথভাবে উদ্যোগ নিতেন, তাহলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় এত দিন বন্ধ থাকতে পারত না।’
মানববন্ধনে শিক্ষকদের উদ্দেশে ফররুখ আহমেদ বলেন, ‘মানুষ আপনাদের নিয়ে কী ভাবছে, সেটা আপনারা বুঝতে পারছেন না। আমি নিজেও একজন শিক্ষক। জনগণ কিন্তু আপনাদের নিয়ে খারাপ ভাবছে। আপনাদের ব্যর্থতা বা গাফিলতি যাই বলেন না কেন, এটা সামগ্রিকভাবে আপনাদের ঘাড়ে পড়বে। কারণ, শিক্ষার্থীদের এখনকার অভিভাবক আপনারাই। আমরা অভিভাবক যাঁরা আসছি আমরা আপনাদের অভিভাবকত্বে আমাদের সন্তানদের রেখে গেছি। বিনিময়ে যে আচরণ আমরা পাচ্ছি, এটা প্রশংসনীয় নয়। এই আচরণ শিক্ষার্থীদের মনেও শিক্ষক সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে।’
ময়মনসিংহ থেকে আসা অভিভাবক কলেজশিক্ষক মকবুল হোসেন বলেন, ‘কুয়েটে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে আমরা গর্বিত ছিলাম। এখন আমরা হতাশ। শিক্ষার্থী-অভিভাবকেরা দুর্বিষহ কষ্টে অপেক্ষা করছেন, কবে ক্লাস শুরু হবে। ইউজিসি হয়তো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে না। আমরা অভিভাবক হিসেবে অনুরোধ করছি, সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের ক্ষমা করে দিয়ে দ্রুত ক্লাস শুরুর ব্যবস্থা করা হোক।’
অভিভাবক এনায়েত করিম বলেন, ‘এখানে যাঁরা পড়ছেন, তাঁরা দেশের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। কুয়েটের সুনাম বিবেচনা করেই আমরা সন্তানদের এখানে ভর্তি করিয়েছি। পাঁচ মাস ধরে নোংরা রাজনীতির কারণে কুয়েট বন্ধ। এতে অনেকের চাকরির সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে, বিদেশি স্কলারশিপ বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের সন্তানেরা যে ক্ষতির মুখে পড়েছেন, তা বর্ণনাতীত। আমার সন্তান যদি দোষী হন, কঠোর শাস্তি দিন, কিন্তু তাঁকে ঘরে বসিয়ে রাখবেন না।’
এ বিষয়ে কুয়েট শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. ফারুক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ’দীর্ঘদিনের প্রশাসনিক এবং একাডেমিক যে জটিলতা তৈরি হয়েছে উপাচার্য না আসলে এটা থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। লিখিতভাবে এটা আমরা সরকার পক্ষের কাছে উপস্থাপন করেছি।’ সেশনজটের বিষয়ে তিনি বলেন, ’সেশনজটটা আস্তে আস্তে লম্বা হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষক সমিতির কর্মসূচির কারণে ক্লাস হয়নি ৪৫ কার্যদিবস। সব মিলিয়ে অনেকদিন হয়ে গেছে। একটা পর্যায় পর্যন্ত ধারণা ছিল আমরা এটা মেকাপ করে দিতে (পুষিয়ে দিতে) পারব। এখনও নিসন্দেহে সেই সর্বোচ্চ চেষ্টাটাই থাকবে।’
শিক্ষার্থীরা ক্লাসে, নেই শিক্ষক
এর আগে আজ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল (ইইই) বিভাগের ৩১৫ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা যায়, ৫০ জনের মতো শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত আছেন। তবে শ্রেণিকক্ষে কোনো শিক্ষক নেই।
২১ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের একজন আশির মুনতাকিম ফেরদৌস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছি। এখন আমরা অনেকটা বাধ্য হয়ে ক্লাসে এসেছি। আমাদের শিক্ষাজীবন থেকে পাঁচটা মাস চলে গেছে। সাবেক ভিসিকে অব্যাহতি দেওয়ার আগে সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত ছিল ৪ মে থেকে ক্লাস শুরু হবে। পরে আর কোনো সিন্ডিকেটে নতুন করে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি যে ক্লাস বন্ধ থাকবে। সে অনুযায়ী আমাদের শিক্ষকদের আইনি কোনো বাধা নেই। আমরা স্যারদের বলছি, আমরা ক্লাসে আসছি, আপনারা সদয় হলে ক্লাস শুরু করেন।’
এ বিষয়ে কুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক আবদুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের অভিভাবক ভিসি ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। ভিসি এলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ। ক্লাস তো নেওয়াই যায়; কিন্তু এটার পর বিশৃঙ্খলা হলে কে সামলাবে। একজন যদি ক্লাস নেন, বাকিরা ক্লাস নেবেন কি না, সেটা কে বলবে? একজন অভিভাবক থাকলে শৃঙ্খলার মধ্যে সবকিছু হয়।’
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শিক্ষার্থীসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের মুখে উপাচার্য ও সহউপাচার্যকে অপসারণ করে সরকার। ১ মে চুয়েটের অধ্যাপক হজরত আলীকে অন্তর্বর্তী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলেও শিক্ষকদের বিরোধিতার মুখে ২২ মে তিনি পদত্যাগ করেন।
১০ জুন উপাচার্য নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হলেও নিয়োগ প্রক্রিয়া অগ্রসর হয়নি। নতুন উপাচার্য নিয়োগ হওয়া পর্যন্ত কুয়েটের বেতন-ভাতা কার্যক্রম চালাতে ইউজিসির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ জামিনুর রহমানকে ১৫ জুলাই থেকে সাময়িক আর্থিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।