গুড় বেচেন, কলের গানেও মজেন

নিজের দোকানে গ্রামোফোনে রেকর্ড বাজাচ্ছেন বাচ্চু মৃধা। গতকাল মুন্সিগঞ্জ সদরের মুন্সিরহাটে
ছবি: প্রথম আলো

‘সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে শুধাই, বল আমারে তোর কি রে আর কূলকিনারা নাই’—ধারেকাছে কোথাও গানটা বাজছে। গানের উৎস ধরে এগোতেই জীর্ণ, ভাঙাচোরা টিনের একটি দোকানঘর চোখে পড়ল। সামনে কিছু গুড় সাজানো। কিছু নারকেল, কলাও আছে। ভেতরে কর্কশিটের ওপর কাঠের একটি বাক্স। দূর থেকে ঠাহর করা যায় না। কাছে গেলেই বোঝা যায় সেটি একটি গ্রামোফোন। সেখান থেকেই ভেসে আসছে আব্দুল আলীমের গান। গ্রামোফোনের কাছেই বসে চোখ বুজে গান শুনছেন এক বয়োবৃদ্ধ।

গান শেষ হলে জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বলেন, দোকানটা তাঁর। গ্রামোফোনটাও তাঁরই। ছোটবেলা থেকেই গানের নেশা। সেই থেকে গ্রামোফোন বা কলের গানের রেকর্ড বাজিয়ে গান শোনেন। আবার রেকর্ডও সংগ্রহ করেছেন সমানতালে। কথা হচ্ছিল মুন্সিগঞ্জ সদরের মুন্সিরহাটের গুড় বিক্রেতা বাচ্চু মৃধার (৭৫) সঙ্গে। বাড়ি তাঁর মুন্সিগঞ্জ সদরেরই টরকি এলাকায়।

শৈশব থেকে গানের নেশা

১৯৬৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করে ইস্তফা দেন। বাবা সিকিম মৃধার সঙ্গে গুড়ের ব্যবসা শুরু করেন বাচ্চু মৃধা। নিজেরা গুড় বানাতেন, কখনো অন্যের বানানো গুড় বেচতেন।

বাচ্চু মৃধা সে সময়কার প্রখ্যাত শিল্পী, গায়ক-গায়িকার গান, সিনেমার গান শুনতেন। প্রথিতযশা শিল্পীদের গানের রেকর্ড নিজের সংগ্রহে রাখার চিন্তাটা শৈশবেই পেয়ে বসে তাঁকে। একটি গ্রামোফোন সংগ্রহের জন্য উঠেপড়ে লাগেন।

পাকিস্তান, কলম্বিয়া, ভারত, ইরান, বাংলাদেশে নানাজনের কাছ থেকে রেকর্ডগুলো সংগ্রহ করেছেন বাচ্চু মৃধা
ছবি: প্রথম আলো

বাচ্চু মৃধা বলেন, গুড়ের ব্যবসা থেকে নিজের পকেট খরচ বাঁচিয়ে সে টাকা জমানো শুরু করলেন। ১৯৬৯ সালের দিকে ৫০০ টাকায় পুরোনো একটি গ্রামোফোন যন্ত্র কেনেন। সেই থেকে শুরু। একে একে চারটি গ্রামোফোন কিনলেন। পাকিস্তান, কলম্বিয়া, ভারত, ইরান, বাংলাদেশে নানাজনের কাছ থেকে রেকর্ডগুলো সংগ্রহ করেছেন। ১০ টাকা থেকে শুরু করে এক হাজার টাকা দিয়েও সংগ্রহ করেছেন এসব রেকর্ড। অযত্নে নষ্ট ও চুরি যাওয়ার পর এখন সাড়ে তিন হাজার রেকর্ড টিকে আছে বলে দাবি করলেন গানপ্রিয় এই মানুষটি।

অনেকে আসেন গান শুনতে

মুন্সিগঞ্জ শহর থেকে সরকারি হরগঙ্গা কলেজের সামনের রাস্তা ধরে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে গেলে মুন্সিরহাট। সেখানেই বাচ্চু মৃধার দোকান। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সেখানে গিয়ে দেখা গেল, দোকানের সামনে টিন ও মাটির পাত্রে গুড় সাজিয়ে বসে আছেন তিনি। পাশেই ২ ফুট দৈর্ঘ্য ও দেড় ফুট প্রস্থের দুটি গ্রামোফোন যন্ত্র। একটিই চালান তিনি। ছোট হাতলের সাহায্যে চাকা ঘুরিয়ে একের পর এক বাজাচ্ছিলেন কালজয়ী সব গান।

কলের গান শুনে হাজির হয়েছিলেন রফিকুল ইসলাম (৭১)। তিনি মুন্সিরহাটে এসেছিলেন সদাইপাতি কিনতে। রফিকুল বলেন, ‘আমাদের সময়ের গান এখন আর কোথাও শোনা যায় না। কোথাও পাওয়া যায় না। তাই যখনই মুন্সিরহাটে সদাই কিনতে আসি, তখনই বাচ্চু মৃধার দোকানে আসি।’

বাচ্চু মৃধার পাশের দোকানদার মো. রিয়াজ উদ্দিন (৭৫)। তিনিও কলের গানের নিয়মিত শ্রোতা। তিনি বলেন, ‘বাচ্চু মৃধা যখন কলের গান বাজান, তখন শৈশবে ফিরে যাই।’

নতুন প্রজন্মের শ্রোতাও আছে। অনেকে ভালোবেসে শোনেন, অনেকেই শুনতে শুনতে নতুন শ্রোতা হয়েছেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিক্রয় প্রতিনিধির চাকরি করেন সিফাতুল ইসলাম (৩০)। দোকানে মালামাল দিতে সপ্তাহে দুই দিন তিনি এখানে আসেন। তিনি বলেন, ‘কলের গানের নাম শুনতাম। টিভিতেও দেখেছি। তবে বাস্তবে দেখছি বাচ্চু মৃধার দোকানে এসে। পুরোনো দিনের গান শুনতে ভালোই লাগে। প্রতিবার হাটে এলেই এখানে গান শুনে যাই।’

অযত্নে নষ্ট ও চুরি যাওয়ার পর এখন সাড়ে তিন হাজার রেকর্ড আছে বাচ্চু মৃধার কাছে
ছবি: প্রথম আলো

সংগ্রহে যা আছে

টরকি এলাকায় একটি দোচালা টিনের ঘরে থাকেন বাচ্চু মৃধা ও তাঁর পরিবার। সংসারে তাঁর স্ত্রী (দ্বিতীয়) ও এক ছেলে আছেন। প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। সে সংসারের ছয় ছেলেমেয়ে সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট্ট সে ঘরে জায়গা কম। তাই দোকানেই রাখেন গ্রামোফোন ও রেকর্ড। একটি স্যুটকেস ও কয়েকটি বাক্সপেট্রায় যত্ন করে রেখেছেন রেকর্ডগুলো। জায়গা না থাকায় বছর পনেরো আগে দুটি গ্রামোফোন বিক্রি করে দেন।

বাচ্চু মৃধা বলেন, ‘দোকানে রেকর্ডগুলো রেখেছিলাম। সেখান থেকে এক কর্মচারী ২০০ রেকর্ড ও পুরোনো যন্ত্রাংশ চুরি করে পালিয়েছে। সংরক্ষণের ভালো জায়গা না থাকায় কিছু রেকর্ড নষ্ট হয়ে গেছে। একটা পাকা বাড়ি বানাতে পারলে সেখানে একটি কক্ষে এসব রেকর্ড রেখে যাব।’

বাচ্চু মৃধার কাছে আছে সুভাষ দত্ত-কবরীর সুতরাং, কবরী-ওয়াসিমের পারুলের সংসার সিনেমাসহ উপমহাদেশের স্বনামধন্য শিল্পীদের গানের রেকর্ড। ষাটের দশকের হিন্দি, উর্দু, কাওয়ালি, পাঞ্জাবি কাওয়ালি, হিন্দি নাটক, বাংলা নাটক, বাংলা ছবি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মারফতি, মুর্শিদি, জারি, সারি গানের রেকর্ড আছে বাচ্চু মৃধার ভান্ডারে।

উপমহাদেশের স্বনামধন্য শিল্পীদের গানের রেকর্ড আছে বাচ্চু মৃধার ভান্ডারে
ছবি: প্রথম আলো

ঐতিহ্য আগলে রাখার তাগিদ

বাচ্চু মৃধার বড় ছেলে রিপন মৃধা (৩৯) বলেন, ‘বাবা যা আয় করতেন, তার অর্ধেক গ্রামোফোনের পেছনে খরচ করতেন। মা অনেক সময় অনেক অভিযোগ করতেন। আব্বাকে সব বিক্রি করে দিতে বলতেন। আব্বা বলতেন, “তোমরা যেমন আমার জীবনের অংশ, এটাও আমার একটা অংশ। তোমাদের ছাড়া যেমন জীবন বাঁচবে না, এটা বিক্রি করে দিলে আমি বাঁচতে পারব না।” এখন আমরা গর্ব করি। আমরাও চাই আব্বার কলের গানের ঐতিহ্য আগলে রাখতে।’

বাচ্চু মৃধা পরম যত্নে আগলে রেখেছেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের রেকর্ড। তাঁর কাছে থাকা রেকর্ডগুলো অনেকেই অনেক বেশি টাকা দিয়ে কিনে নিতে চেয়েছেন। তিনি কারও কাছে বিক্রি করেননি। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত এই সংগ্রহশালা আগলে রাখতে চান তিনি।

বাচ্চু মৃধার কলের গানের যে বিশাল সংগ্রহশালা, তা সত্যি বিরল—মন্তব্য করে মুন্সিগঞ্জ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সুজন হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি প্রকৃত অর্থে একজন সংগীতপ্রেমী ও সংগীতবোদ্ধা মানুষ। একজন গুড় ব্যবসায়ী হয়েও তাঁর সংগ্রহে দেশীয় সংগীতের মূল্যবান ভান্ডার আছে। হারিয়ে যাওয়া কলের গানের এই সমৃদ্ধ সংগ্রহ দেশের সম্পদ। অনাদরে–অবহেলায় যেন এই সম্পদ বিনষ্ট না হয়। এগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।