অ্যানথ্রাক্স সংক্রমণে গরুশূন্য গোয়াল, ছোট খামারিদের বড় ক্ষতি

সিরাজুল ইসলামের বাড়িতে আর গরু নেই। গরু রাখার ঘরও সম্প্রতি ভেঙে ফেলেছেন তিনি। ২৫ অক্টোবর রংপুরের পীরগাছার আনন্দী ধনীরাম গ্রামেছবি: প্রথম আলো

রংপুরের পীরগাছা উপজেলার আনন্দী ধনীরাম গ্রামের দিনমজুর সিরাজুল ইসলাম (৬৫)। বাড়িতে দুটি গরু ছিল। গত সেপ্টেম্বরে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে চার মাসের গাভিন শাহিওয়াল জাতের গরুটি মারা যায়। অন্য গরুটি অসুস্থ হয়ে পড়লে সেটি জবাই করতে হয়। এর পর থেকে তাঁর গোয়ালঘর গরুশূন্য। সম্প্রতি ভেঙে ফেলেছেন জরাজীর্ণ সেই গোয়ালও।

২৫ অক্টোবর তাঁর বাড়িতে গেলে সিরাজুল বলেন, শূন্য গোয়াল রেখে কী করবেন? তাঁর কিছুই নেই করে খাওয়ার মতন। যদি বাঁশ-টিন-কাঠ বিক্রি করে ৫ কেজি চাল আনতে পারেন, তাহলে পাঁচ দিন যাবে। এর পরের খোরাকি তিনি কোথায় পাবেন?

অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে শুধু সিরাজুলের গরু মারা যায়নি, তাঁদের পরিবারেও অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সংক্রমিত গরু জবাই করে মাংস কাটাকাটি ও খাওয়ার পর পরিবারের ৪–৫ জনসহ ওই এলাকার ২০–২৫ জন অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হন। সিরাজুলের ভাবি কমেলা বেগম (৭০) মাংস কাটার পর অসুস্থ হয়ে মারা যান। সিরাজুলও অসুস্থ ছিলেন। তাঁর চিকিৎসায় অন্তত ১৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে বলে তিনি জানান। এখন তিনি কিছুটা সুস্থ।

স্থানীয় সূত্র জানায়, গত সপ্তাহে পীরগঞ্জ উপজেলায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত গরু জবাইয়ের পর মাংস কাটার সঙ্গে যুক্ত নয়জন আক্রান্ত হন। রংপুর জেলায় এখন পর্যন্ত শতাধিক মানুষ অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গে আক্রান্ত হয়েছেন। গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে এই রোগে কমেলা বেগম ছাড়াও আবদুর রাজ্জাক নামের এক ভ্যানচালক মারা যান। গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে পীরগাছার কয়েকটি ইউনিয়নে অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ দেখা যায়। পীরগাছা ছাড়াও কাউনিয়া, মিঠাপুকুর, গঙ্গাচড়া, তারাগঞ্জে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। এসব এলাকায় শতাধিক গরু–ছাগল মারা গেছে।

আনন্দী ধনীরাম গ্রামের বাসিন্দারা জানান, অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে এই গ্রামের রইস উদ্দিন, রমজান আলী, রফিকুল ইসলামসহ ছয়জনের সাতটি গরু এবং আরও তিনজনের আটটি ছাগল মারা গেছে। এই ব্যক্তিরা কেউ দুধ বিক্রি করে সংসার চালাতেন, কেউ বছর শেষে গরু বিক্রি করে সংসারের চাহিদা মেটাতেন।

আবু তাহেরের খামারটিও এখন গরুশূন্য। ২৫ অক্টোবর রংপুরের পীরগাছার কুটিপাড়া গ্রামে
ছবি: প্রথম আলো

সিরাজুল ইসলামের পাশের বাড়ির রমজান আলী ও তাঁর ছোট ভাইয়ের বাড়িতেও শূন্য গোয়াল দেখা গেছে। রমজান আলী বলেন, ‘দিনমজুরি দিয়া খাই। দুই-একটা গাভি পুষি চলতাম। তড়কা (অ্যানথ্রাক্স) রোগের ভয়ে চারটি গরু বিক্রি করে দিছি। আমারও একটা গরু মারা গেছে।’

জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, রংপুরের চার উপজেলার ৩১ খামারির ১১৩টি সন্দেহভাজন গবাদিপশুর মধ্যে ৫০টি অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হয়। ১৯টি মারা গেছে, ৩০টি জবাই করা হয় এবং একটি চিকিৎসায় সুস্থ হয়েছে। গত ২৬ আগস্ট থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত আট উপজেলায় ৩ লাখ ২৯ হাজার ৭০০ গরুকে অ্যানথ্রাক্স টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকাদান কার্যক্রম চলছে।

পীরগাছার পিয়ারপাড়ার বাসিন্দা মমতাজ বেগম বলেন, ১৫-১৬ দিন আগে তাঁদের সাত মাসের একটি বাছুর মারা গেছে। একই এলাকার ইব্রাহিম নামের একজনের ছাগল আক্রান্ত হয়, সেটি তাঁরা জবাই করেছেন।

পীরগাছার কুটিপাড়ার বাসিন্দা আবু তাহের ও আবু তালেব দুই ভাই হাটে পুরোনো কাপড় বিক্রির পাশাপাশি বাড়িতে গরুর খামার করেছেন। অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে তাঁদের চারটি গাভি মারা গেছে। আবু তাহের বলেন, ‘নিঃস্ব হইছি। সরকারের কেউ দেখতে আসল না।’ তিনি জানান, তাঁর বাড়ির আশপাশে সাতটি গরু মারা গেছে। ছাগল মারা গেছে চারটি।

কুটিপাড়া থেকে আধা কিলোমিটার পশ্চিমে মণ্ডলপাড়ায় গিয়ে জানা যায়, সেখানেও ৮-১০টি গরু মারা গেছে। মণ্ডলপাড়ার বাসিন্দা হামিদা বেগম বলেন, তাঁর একটি গাভি মারা গেছে। আরেকটি বকনা এখনো আক্রান্ত। সেখানকার খামারিরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে তাঁদের বড় ক্ষতি হলেও প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে কেউ খোঁজ নেননি। তাঁরা ক্ষতিপূরণের দাবি জানান।

এ বিষয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মো. আবু ছাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণে গবাদিপশুর মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা নেই। তবে তাঁরা ছোট খামারিদের ক্ষতি পোষাতে নানাভাবে সহযোগিতার কথা ভাবছেন।