জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: সরেজমিন ঢাকা ও বাগেরহাট
বাস্তুচ্যুতির পরিসংখ্যান নেই, ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা
সালটা ১৯৮৮। বরিশালের উজিরপুরের বেলায়েত হোসেন তখন সদ্য বিয়ে করেছেন। ছিলেন জাহাজের কর্মচারী। সন্ধ্যা নদীর তীরে ছিল তাঁদের বাড়ি। ’৮৮–এর বন্যায় ঘরবাড়ি সব বিলীন হয়ে যায়। জীবিকার সন্ধানে নববধূর হাত ধরে বাগেরহাটের মোংলার উদ্দেশে পাড়ি জমান তিনি।
বাগেরহাটের কয়েকটি এলাকায় উদ্বাস্তুর মতো ছিলেন তিন দশক। ২০১৯ সালে মোংলা পৌরসভার নারিকেলতলা আবাসন প্রকল্পে সরকারি একটি ঘর পান বেলায়েত। পাঁচ সদস্যের পরিবারটি ৫০০ বর্গফুটের টিনের চালার ঘরটিতে মাথা গুঁজে আছে কোনোমতে।
উপকূলীয় এলাকায় নদীভাঙন, একের পর এক ঘূর্ণিঝড়সহ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা দুর্যোগের মুখোমুখি হয়ে ভিটেমাটি, সহায়সম্বল হারাচ্ছেন বেলায়েতের মতো অনেকে। সুপেয় পানির সংকটের কারণে মরণব্যাধি, মেয়েদের গায়ের রং মলিন ও ত্বক খসখসে হওয়া, ফসলি জমিতে আবাদ না হওয়ার মতো জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েও ভিটেমাটি আঁকড়ে বাঁচতে চায় মানুষ। আর কোনো উপায় না থাকলে এক জেলা থেকে আরেক জেলা, রাজধানী অথবা দেশের বড় শহরগুলোর দিকে ছোটে মানুষ। এভাবেই বাড়ছে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা।
আবার বাস্তুচ্যুতি এত বেশি হারে হচ্ছে যে গবেষকেরা বিশ্লেষণ করে চার বছর আগে অভিবাসনের যে হার ও সংখ্যার কথা বলেছিলেন, চার বছর পর সেই লক্ষ্যমাত্রা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। যেমন ২০১৮ সালের মার্চে বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভিটেমাটি হারানো বাংলাদেশির সংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে ১ কোটি ৩৩ লাখে পৌঁছাতে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মোট উদ্বাস্তু জনসংখ্যার তিন ভাগের এক ভাগ।
কিন্তু ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘গ্রাউন্ডসওয়েল’ প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীর সংখ্যা দক্ষিণ এশিয়ার মোট অভ্যন্তরীণ জলবায়ু অভিবাসীর প্রায় অর্ধেক হয়ে উঠতে পারে, যা সংখ্যার বিচারে ১ কোটি ৯৯ লাখ।
জলবায়ু অভিবাসীদের দুরবস্থা, রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর বস্তিতে তাদের টানাপোড়েনের জীবন নিয়ে আলোচনা চলছেই। কিন্তু উপকূলের কোন অঞ্চল থেকে কী পরিমাণ জলবায়ু উদ্বাস্তু অভিবাসন নিচ্ছে, কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে, এর সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ আবদুল লতিফ খান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ আসলে সহিষ্ণু (রেজিলিয়েন্ট)। তারা যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে। যারা অভিবাসী হচ্ছে তারা নিজেদের জীবনধারণের জন্য কোনো না কোনো ব্যবস্থা করে নিচ্ছে। কিন্তু এটি সত্য, এটা স্রেফ মানিয়ে নেওয়া। তাদের পরিস্থিতি আগের মতো হচ্ছে না। তারা মানবেতর জীবন যাপন করলেও টিকে আছে। এ টিকে থাকা মানুষদের সহায়তা করতে হলে পরিসংখ্যানের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি।
বাস্তুচ্যুতির হার কেমন
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, স্বল্প অথবা দীর্ঘ মেয়াদে দেশের অভ্যন্তরে বা দেশের বাইরে স্থানান্তরকে জলবায়ু বাস্তুচ্যুতি বলে। অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের (আইডিএমসি) তথ্য অনুসারে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশের বার্ষিক বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা ৯ লাখ ১৫ হাজার। চলতি শতকের শুরুর দশকে এই সংখ্যা ছিল গড়ে সাত লাখ।
আইডিএমসির সম্প্রতি প্রকাশিত গ্লোবাল রিপোর্ট অন ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্টে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২৪) অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতির শীর্ষে থাকা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান বিশ্বে পঞ্চম। সংখ্যাটা ১৭ লাখ ৯১ হাজার। সংস্থাটির তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ১৫ লাখ, ২০২১ সালে প্রায় ১০ লাখ, ২০২০ সালে দুর্যোগের কারণে প্রায় ৪৪ লাখ, ঘূর্ণিঝড় ফণী ও বুলবুলের কারণে ২০১৯ সালে ৪০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আইডিএমসির তথ্য বলছে, উপকূলীয় জেলা, যেমন ভোলা, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরার মতো জেলাগুলো থেকে বাস্তুচ্যুতি বেশি ঘটে। প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের বছরগুলোতে বাস্তুচ্যুতির সংখ্যা বেড়ে যায়। যেমন ঘূর্ণিঝড় আম্পানের ফলে ২৫ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। তবে তাদের বেশির ভাগই আবার নিজেদের জায়গায় ফিরে গেছে বলে জানিয়েছেন রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী।
জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত আন্তসরকারি প্যানেলের (আইপিসিসি) ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ২১০০ সালের মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আধা মিটার (০.৪৮) থেকে ২ মিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। যে কারণে বাংলাদেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে শুধু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই এসব অঞ্চলের ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।
কোথায় যাচ্ছে বাস্তুচ্যুতরা
মোংলা পৌরসভার নারিকেলতলা আবাসন প্রকল্প এখন যে এলাকায়, সেখানে আগে কোনো মানববসতি ছিল না। ১৫ বছর আগে সরকারি এই খাসজমিতে গৃহহীনদের জন্য ঘর স্থাপন করে সরকার। তখন থেকে সেখানে ৬০টি পরিবার বাস করছে। শুরুতে জনসংখ্যা কম থাকলেও বর্তমানে এখানে প্রায় ৪০০ মানুষের বাস। বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বলছে, এসব পরিবারের সদস্যরা হয় অন্য কোনো উপকূলীয় জেলা অথবা বাগেরহাটের অন্য কোনো স্থান থেকে এসে বসতি গড়েছে।
মোংলা নিজেই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা একটি উপজেলা। তবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মোংলা রপ্তানিজাতকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও মোংলা সমুদ্রবন্দরে জীবিকার সুযোগের কারণে এখানে জলবায়ু অভিবাসীরা আশ্রয় নিচ্ছে। এভাবে অভিবাসনের ফলে ২০১১ সালে মোংলায় যেখানে ৪০ হাজার মানুষ বসবাস করত, সেখানে এখন ১ লাখ ৫৮ হাজারের বেশি মানুষের বাস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের যেসব এলাকায় কাজের সুযোগ আছে, সেসব এলাকায়, বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলো এবং কখনো দেশের বাইরে অভিবাসন নিচ্ছে বাস্তুচ্যুতরা। ফলে শহরগুলোর ওপর চাপ বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি ও গৃহগণনার মহাপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার জনসংখ্যা ৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। মেয়রস মাইগ্রেশন কাউন্সিল বলছে, রাজধানীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বাস্তুচ্যুতি ও অভিবাসন।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যারা অভিবাসন নিচ্ছে তাদের প্রায় ৬০ শতাংশ রাজধানী ঢাকা, ২০ শতাংশ চট্টগ্রাম শহরে ও ২০ শতাংশ আন্তজেলায় অভিবাসী হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজনের ক্ষেত্রে অভিবাসন অন্তর্ভুক্তিকরণ (অ্যাকোমোডেটিং মাইগ্রেশন ইন ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাডাপটেশন) শিরোনামের এ গবেষণার নেতৃত্ব দেন রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানী ও চট্টগ্রামের অভিবাসীদের বেশির ভাগই বস্তিতে থাকে। তারা আবার নিজ এলাকার মানুষ রয়েছে, এমন অঞ্চলভিত্তিক বস্তিগুলোতে অভিবাসন নেয়। যেমন ঢাকার ভোলা বস্তিতে বরিশাল বিভাগের লোকজনের সংখ্যা বেশি।
২০২১ সালে মেয়রস মাইগ্রেশন কাউন্সিল থেকে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের উপকূলীয় নিম্নভূমির পরিমাণ ৭১০ কিলোমিটার। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বিস্তীর্ণ নিম্নভূমি থেকে প্রতিদিন দুই হাজার মানুষ রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর হচ্ছে। প্রতিবছরই ঢাকায় চার লাখের মতো নিম্ন আয়ের অভিবাসী আসে। যারা রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে বসবাস করছে।
প্রভাব কী
১৫ বছর আগে সুমনা বেগম (২৫) তাঁর মায়ের সঙ্গে পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি থেকে মোংলায় আসেন। বয়স হওয়ার পর সুমনা মোংলা ইপিজেডে কাজ নেন। বছর তিনেক আগে সুমনার চাকরি চলে যায়। গত বছর তাঁর মা মারা যান। তাঁর স্বামী আরেক নারীর সঙ্গে পালিয়ে যান। এখন এক শিশুসন্তানকে নিয়ে কোনরকমে জীবন যাপন করছেন এই তরুণী।
সুমনা বলেন, ‘মা মারা যাওয়ার পর এখানে আমার আপন বলতে কেউ নেই। স্বরূপকাঠিতে যে আত্মীয়স্বজন আছে, তাদের সঙ্গেও কোনো যোগাযোগ নেই। এখন আমি কী করব বুঝতে পারছি না। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে তারা হয়তো সহযোগিতা করত।’
মোংলা ইপিজেডে কাজের সুযোগ আছে—এমন তথ্য জেনে সুমনার মা হেনা বেগমের মতো বাস্তুচ্যুতরা মোংলায় আসে। তারা মোংলার মূল শহরে বসতি গড়ছে। তবে কাজের জন্য পশুর নদ পাড়ি দিয়ে মোংলা সমুদ্রবন্দর বা ইপিজেড এলাকায় যেতে হয়।
এদিকে অভিবাসীদের জন্য বিপদ বেড়েছে স্থানীয় লোকজনের। গ্রামের কৃষিজমিতে লোনাপানি প্রবেশের ফলে ফসলি জমিতে আবাদ হচ্ছে না, জমি পড়ে আছে বছরের পর বছর। কিছু ফসলি জমিতে জায়গা করে নিয়েছে চিংড়ি। তবে সাদা ভাইরাসের কারণে চিংড়ি চাষও এখন ঝুঁকির মুখে। কৃষকেরা কৃষিতে ফিরতে চাইছেন এবং অনেক এলাকায় কৃষিকাজে ফিরেছেনও। কিন্তু যে পরিমাণ লবণ জমিতে মিশেছে, তা দূর হতে ২৫ থেকে ৩০ বছর লাগবে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন। ফলে মোংলা থেকে অন্য জেলায় যাচ্ছে স্থানীয় লোকজন।
মোংলার চিলা ইউনিয়নের বাসিন্দা স্বপ্না অধিকারী বলেন, ‘মোংলার পশুর নদের ধারের পূর্বধলা গ্রামে আমাদের বাড়ি ছিল। নদীভাঙনে পাড়াটি বিলীন হলে সেখান থেকে আমরা চিলাতে চলে আসি। আমাদের চার–পাঁচটি পরিবার খুলনার দাকোপে চলে যায়।’
বিপদে তিন শ্রেণির মানুষ
গবেষকেরা বলছেন, অভিবাসনের ফলে তিন শ্রেণির মানুষ বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এক. অভিবাসী নিজে, ২. অভিবাসন এলাকায় থেকে যাওয়া মানুষ, ৩. যে এলাকায় অভিবাসন ঘটে, সেই এলাকার মানুষ। গবেষণায় দেখা গেছে, অভিবাসনের ফলে খাদ্যনিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। অর্থনৈতিক অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয় না; বরং দারিদ্র্যের হার আরও বেড়ে যায়। ঢাকার ভোলা বস্তির দিকে নজর দিলে এ পরিস্থিতি আরও পরিষ্কার হয়।
১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে ভোলায় পাঁচ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬০ থেকে ২০১৭ সালের মে পর্যন্ত এই অঞ্চলের ইতিহাসে ভোলা ঘূর্ণিঝড় ছিল অন্যতম মারাত্মক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশের সীমানায় আঘাত হানা এই ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২২৪ কিলোমিটার। এর প্রভাবে ১০ থেকে ৩৩ ফুট জলোচ্ছ্বাস হয়। পুরো উপকূলে ক্ষতি হয় ৮৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের সম্পদ। পরে ঢাকায় অস্থায়ীভাবে ‘ভোলা বস্তি’ নামকরণ করে ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা পুনর্বাসন নেয়।
আইপিসিসির ষষ্ঠ মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়, মানুষের মৌলিক চাহিদার চরম সংকটের পাশাপাশি ভোলা বস্তির মানুষের মধ্যে অধিকারবোধহীনতা, আত্মপরিচয়ের সংকট, গুণগতমানের অবক্ষয়, সামাজিক মর্যাদাহানির কারণে উচ্চপর্যায়ের মানসিক অবসাদের সৃষ্টি হয়েছে। গবেষণা বলছে, এ রকম চরম মানবিক সংকটের মধ্যে প্রতিবছর ভোলাসহ ঢাকার বস্তিগুলোতে যে চাপ বাড়ছে, তাতে মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।
সরেজমিনে ভোলা বস্তি
রাজধানীর মিরপুরের পল্লবী এলাকায় ওয়াসা ও গৃহায়ণ অধিদপ্তরের জমিতে গড়ে উঠেছিল ভোলা বস্তি। ওয়াসা ইতিমধ্যে তাদের জায়গায় আবাসিক কোয়ার্টার গড়ে তুলেছে আর গৃহায়ণ অধিদপ্তর বস্তি উচ্ছেদ করে জায়গা খালি করেছে। স্থানীয় লোকজন বলছে, এখানে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৬০০টি পরিবার বসবাস করত। বস্তি উচ্ছেদের পর সরকারি জায়গায় এক সারিতে শতাধিক পরিবার এবং এর পাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমিতে আরও ৪০ থেকে ৫০টি পরিবার বাস করছে।
গত বছরের জুন এবং গতকাল বুধবার দুই দফায় ভোলা বস্তিতে গিয়ে দেখা গেছে, একটি লম্বা গলির দুই দিকে টিনের চালার ঘর বানিয়ে বসবাস করছে অভিবাসীরা। ৩০০ থেকে ৫০০ বর্গফুটের একেকটি ঘরে তিন থেকে আটজনের পরিবারগুলো বসবাস করছে। কোথাও কোথাও ঘরের ওপর ঘর তুলে কাঠের সিঁড়ি বানিয়ে থাকার ব্যবস্থা করেছে তারা। ওই এক ঘরের মধ্যেই রান্নাবাড়া, পানি সররাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বস্তির গলিতে ঢোকার মুখে প্রথম ঘরটি আয়েশা বেগম ও ওমর ফারুক দম্পতির। আয়েশা বেগমের বয়স যখন ১৪, তখন তাঁর শাশুড়ি বিবি সখিনার সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। বিবি সখিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি সব যখন ভাইঙ্গা গ্যালো, তখন সব পোলাপাইন লইয়া এইহানে আইছিলাম। তিন পোলারে নিয়া আশায় বুখ বাইন্ধা আছিলাম। সরকারের লোক সব ভাইঙ্গা দিল, এহন এখানে বাঁইচা আছি কোনোরকম।’
গত বছর আয়েশা বেগম প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ‘১৩ বছর বয়সে আমার বিয়ে হলো। এর পরের বছরই ঢাকায় চলে আসতে হলো। তখন থেকে ঢাকাতেই আছি। এখানেই তিন মেয়ে আর এক ছেলের জন্ম হয়। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছি। চাইছিলাম ছেলেটাকে পড়াশোনা করাব। কিন্তু একে অভাব, তার ওপর বছর পাঁচেক আগে বস্তি ভেঙে দিল। অভাবের সংসারে ছেলেটার আর পড়াশোনা হলো না।’
আয়েশার স্বামী ওমর ফারুক বলেন, ‘নদী ভাঙ্গার পর নিজের এলাকা ছেড়ে আসার কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না। তারপরও আশায় বুক বেঁধে এখানে ঘর বানাইছিলাম আমরা। বস্তিবাসীর ঘামের টাকায় এখানে মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানা বানানো হইছিল। সব ভেঙ্গে দিছে। সত্যি কথা কী, নদী ভাঙ্গনে এত কষ্ট পাই নাই। যতটা বস্তি উচ্ছেদের পর পাইছি।’
সরকারি এই জায়গা থেকে বাকি পরিবারগুলোকেও যেকোনো দিন উচ্ছেদ করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। ৭৭ বছর বয়সী রোসনা বেগম বলেন, ‘ঘর ভাইঙ্গা দিলে কই যামু, আল্লাহই জানে!’
কেন পরিসংখ্যান ও পরিকল্পনা দরকার
তিনটি কারণে জলবায়ু অভিবাসন মোকাবিলার ক্ষেত্রে শহরের উন্নয়ন ও পরিকল্পনার গুরুত্ব রয়েছে বলে এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জেস জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। ‘জলবায়ু পরিবর্তন এবং শহরগুলোয় অভিবাসনের প্রভাব: বাংলাদেশ থেকে শিক্ষা’ শীর্ষক ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, উচ্চ জনসংখ্যার ঘনত্ব, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা ও পরিবেশগত ঝুঁকির কারণে যে হারে অভিবাসন হচ্ছে, তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাধা তৈরি করছে।
গবেষণাটিতে বলা হয়, যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কেন্দ্র হলো শহর। দিন শেষে জীবিকা নির্বাহের জন্য শহরই চূড়ান্ত গন্তব্য। এ কারণে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের বড় শহরগুলোও দরিদ্র মানুষের শহর হয়ে যাচ্ছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশের নগর কর্তৃপক্ষের পক্ষে জলবায়ু অভিবাসীদের আবাসন এবং অন্যান্য পরিবেশগত সেবা সরবরাহ করা অসম্ভব বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, শহরের বস্তিগুলোতে মানুষের ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই। আবার প্রতিটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর শহরে নতুন করে বস্তি স্থাপিত হচ্ছে। এভাবে শহরের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির আকার বাড়ছে এবং এটা নগর কর্তৃপক্ষের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কতজন জলবায়ু অভিবাসী কী কারণে শহরে বসতি স্থাপন করছে এবং কীভাবে তারা নতুন পরিবেশে খাপ খাচ্ছে—শুধু এই দুই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা যথেষ্ট নয়; বরং জলবায়ু অভিবাসনের এই প্রক্রিয়া কীভাবে শহরগুলোকে প্রভাবিত করছে, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী, তা জানতে এবং শহরকে সবার জন্য বসবাসযোগ্য করতে কিংবা বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান একান্ত জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, যদি সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের গ্রাউন্ডসওয়েল প্রতিবেদনে বাস্তুচ্যুতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে (১ কোটি ৯৯ লাখ), সেটিই ঘটবে। এটি মোকাবিলায় সরকারের কাজ করে যেতে হবে।
তাসনিম সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তুচ্যুতির সুনির্দিষ্ট তথ্য–উপাত্ত না থাকায় জাতিসংঘের জলবায়ু তহবিল বা জলবায়ু ক্ষতিপূরণে গঠিত অন্য আন্তর্জাতিক তহবিলের কোথাও সাহায্যের আবেদন করা যায় না। কারণ, সংস্থাগুলো বাস্তুচ্যুতির সুনির্দিষ্ট তথ্য চায় এবং সেটাই স্বাভাবিক। সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া কিসের ভিত্তিতে অর্থসহায়তা দেবে তারা?’