চিকিৎসক কম, মিলছে না সেবা

এখানে কোনো জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তা নেই। পাঁচজন চিকিৎসা কর্মকর্তার চারটি পদই শূন্য।

শিশুবিশেষজ্ঞকে দেখাতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ২০১৯ নম্বর কক্ষের সামনে অসুস্থ শিশুদের কোলে নিয়ে নারীদের ভিড়। গত বৃহস্পতিবার
প্রথম আলো

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালকে ৫০ থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করার ২০ বছর পরেও সে অনুযায়ী জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়নি। পদোন্নতিবিষয়ক কারণে চার বছর আগে চারজন চিকিৎসককে বদলি করা হলেও শূন্য পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। চিকিৎসকসহ অন্য পদেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল নেই। এতে এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আতাউর রহমান মুন্সী জনবলসংকটের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, বর্তমানে অন্তবিভাগে তিন শতাধিক এবং বহির্বিভাগে আট শতাধিক রোগীকে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। এ অবস্থায় ১০০ শয্যার নয়, প্রয়োজন ২৫০ শয্যার জনবল। আতাউর বলেন, চিকিৎসক–সংসকটের সমস্যা মোকাবিলা করোর জন্য চিকিৎসক প্রেষণে এনে সেবা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।

গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন গেলে এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবার করুণ চিত্রই ফুটে ওঠে। জীবননগর উপজেলার রায়পুর থেকে বৃহস্পতিবার সকাল সাতটায় রওনা দেন ফাতেমা খাতুন। ২০ দিন বয়সী অসুস্থ ছেলে মুত্তাকিনকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য তিনি এখানে আসেন। ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সাড়ে আটটায় সদর হাসপাতালে পৌঁছান। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ ও রেফার স্লিপ পেতেই দুপুর সাড়ে ১২টা বেজে যায়। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ  মাহবুবুর  রহমানের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলেকে বড় চিকিৎসককে দিয়ে দেখানোর আশায় বুক বাঁধেন ফাতেমা। কিন্তু বেলা একটায় মাহবুবুর কক্ষ থেকে বেরিয়ে আর ফেরেননি। 

শেষ পর্যন্ত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কক্ষে বসা ইন্টার্ন উপসহকারী কমিউনিটি চিকিৎসা কর্মকর্তা (স্যাকমো)রুবেল হোসেনের কাছে সন্তানকে দেখিয়ে চোখেমুখে অসন্তোষের ছাপ নিয়ে ফিরে যান। একই অভিজ্ঞতা চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার দক্ষিণ গোরস্তানপাড়ার মম খাতুনসহ অনেকেরই। মালোপাড়ার বাসিন্দা ছন্দা হালদার ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘দুপুর দুইটা পর্যন্ত ডাক্তারের থাকার কথা। অথচ এক ঘণ্টা আগেই বেরিয়ে গেলেন, এখন কোথায় যাব?’ 

বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় জরুরি বিভাগে রোগীর ভিড় চোখে পড়ে। চিকিৎসা কর্মকর্তা শাপলা খাতুনকে  ইন্টার্ন স্যাকমো ইমোনা খাতুন, অন্তরা খাতুন ও ঊর্মি আক্তার সহযোগিতা করছেন। দোতলায় ২০০৯ নম্বর কক্ষের সামনে তিন শতাধিক নারী-পুরুষের ভিড়।  

আলমডাঙ্গা উপজেলার মুন্সিগঞ্জ থেকে আসা জাহিরন বেগম আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বসে পড়েন। এই কক্ষে বসেন  আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন কবীর। রোগীদের আয়ুর্বেদপ্রীতি নিয়ে খোঁজ নিতেই জানা গেল পরামর্শ ছাড়া হাসপাতালের বিশেষজ্ঞরা সরাসরি রোগী দেখেন না, তাই এত ভিড়। গাইনি ওয়ার্ডে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়ার টিকিট নিয়ে অসহায়ের মতো ঘুরছিলেন দামুড়হুদার রামনগর থেকে আসা প্রসূতি মেরিনা খাতুন। তিনি বলেন, ‘তাঁকে গাইনি–বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেছেন। কক্ষটি চেনেন না, কেউ সহযোগিতাও করছেন না। এই প্রতিবেদক ওই নারীকে সহযোগিতা করেন।

এ বিষয়ে হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও)  ফাতেহ আকরাম জানান, সাধারণ ও  জটিল রোগী বিভাজন করতেই  এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাতে জটিল রোগীকে পরামর্শকেরা বেশি সময় দিতে পারছেন এবং সাধারণ রোগীরা চিকিৎসা কর্মকর্তাদের চিকিৎসা পাচ্ছেন। আরএমও বলেন, হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি রোগী দেখেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ মাহবুবুর রহমান। তাঁকে একাই অন্তর্বিভাগ ও বহির্বিভাগ মিলে পাঁচ শতাধিক রোগীর চিকিৎসা দিতে হয়।  

শুধু নেই আর নেই

১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত ৫০ শয্যার সদর হাসপাতালকে ২০০৩ সালে ১০০ শয্যার হাসপাতালে উন্নীত করা হয়। তখন থেকে শুধু ওষুধ সরবরাহের অনুমোদন দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হওয়ার ১৯ বছর পর কাগজে-কলমে জেলাবাসী ১০০ শয্যার হাসপাতাল পেলেও  প্রয়োজনীয় লোকবল পায়নি। দেশের সব কটি সদর হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসা কর্মকর্তার (ইএমও) পদ থাকলেও একমাত্র চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরেই তা নেই। 

কর্মকর্তারা জানান, জরুরি বিভাগ পরিচালনার জন্য ১৯৯৮ সালের ৩ আগস্ট ইএমও পদ সৃষ্টি করে তিনজন চিকিৎসককে পদায়ন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে ২০০১ সালের ১০ আগস্ট তা বিলুপ্ত করা হয়। ১০০ শয্যার অনুকূলে চিকিৎসকসহ জনবল অনুমোদনপ্রাপ্তির জন্য বিভিন্ন সময়ে সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়র দফায় পত্র দেওয়া হলেও কার্যত কোনো লাভ হয়নি।

এদিকে ৫০ শয্যার বিপরীতে ছয়জন জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া, গাইনি, শিশু, মেডিসিন ও অর্থোপেডিক সার্জারি) ও পাঁচজন কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ (সার্জারি, অ্যানেসথেসিয়া, অর্থোপেডিক ও ট্রমা, নাক কান গলা (ইএনটি) ও রেডিওলজি এবং একজন আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও), পাঁচজন চিকিৎসা কর্মকর্তা, একজন দন্ত চিকিৎসক, একজন প্যাথলজিস্ট, একজন রেডিওলজিস্ট, একজন হোমিও ও একজন আয়ুর্বেদ চিকিৎসা কর্মকর্তা নিয়ে ২২টি পদ রয়েছে। বর্তমানে এসব পদের বিপরীতে চক্ষু, অ্যানেসথেসিয়া, শিশু, মেডিসিন বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ;ইএনটি ও রেডিলজি বিভাগের কনিষ্ঠ বিশেষজ্ঞ এবং রেডিওলজিস্টের একটি ও চিকিৎসা কর্মকর্তার দুটি পদ চার বছরেরও বেশি সময় ধরে শূন্য রয়েছে। আবার তিনজন চিকিৎসা কর্মকর্তার মধ্যে একজন জেলা কারাগারের চিকিৎসক হিসেবে সংযুক্ত রয়েছেন কয়েক বছর। আরেকজন উচ্চশিক্ষার জন্য কয়েক দিনের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা ছাড়ছেন। অর্থাৎ জেলার প্রধান হাসপাতালে অবশিষ্ট থাকছেন মাত্র একজন চিকিৎসা কর্মকর্তা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ধার করা পরামর্শক ও চিকিৎসক দিয়ে সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবা পরিচালিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কার্যালয় থেকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওয়ালিউর রহমান। এ ছাড়া দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা আবুল হোসেন মেডিসিন বিভাগের বিশেষজ্ঞ, গাইনি বিশেষজ্ঞ এবং আলমডাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের চিকিৎসা কর্মকর্তা আসাদুল হক মালিক ওরফে খোকন শিশু বিভাগের পরামর্শক হিসেবে সংযুক্ত আছেন।