সিলেটের সুজন নেতার সাক্ষাৎকার

নির্বাচনী বিধিকে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন

সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০২ সালে। ৭৯ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই নগরে ওয়ার্ড আছে ৪২টি। মোট ভোটার ৪ লাখ ৮৬ হাজার ৬০৫ জন। আগামী ২১ জুন পঞ্চমবারের মতো সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোট হবে ইভিএমে। প্রতীক বরাদ্দ হবে ২ জুন। তবে এর আগেই মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা মিছিল-সমাবেশ করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করে একাধিক সংসদ সদস্য ও সরকারি কর্মকর্তারা প্রচারণায় চালিয়েছেন। এসব নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে।

প্রশ্ন:

নির্বাচনী পরিবেশ কেমন দেখছেন?

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী: একতরফা একটা পরিবেশ সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে চলছে। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর সমর্থনে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চলেছে। সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ও সরকারি কর্মকর্তারা পর্যন্ত বিধিবহির্ভূতভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমনকি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী যেভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন, একেবারে প্রতীক নিয়ে, প্রতীক দেখিয়ে; সেটা দুঃখজনক। প্রতিদিনই একাধিক সভা করে তিনি ভোট চাইছেন। তাঁর দল ও সহযোগী অঙ্গসংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরাও লিফলেট বিতরণ করা থেকে শুরু করে প্রকাশ্যে গণসংযোগ শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পাশাপাশি কিছুটা কম হলেও জাতীয় পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থীকেও আচরণবিধি লঙ্ঘন করে প্রচারণা চালাতে দেখা যাচ্ছে। বিধি ভেঙে প্রার্থীদের এমন প্রচারণা প্রতিদিনই চলছে।

প্রশ্ন:

এই যে প্রতিদিনই একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটছে, বিষয়টাকে কীভাবে দেখছেন?

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী: নির্বাচনী বিধিবিধানকে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে ছয়জন সংসদ সদস্য ভোট চেয়েছেন। এভাবে ভোট চাওয়া যে আচরণবিধি লঙ্ঘন, সেটা তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন। এরপরও তাঁরা তা করছেন। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখতে সংসদ সদস্যদের সংযত আচরণ প্রত্যাশা করেন ভোটারেরা। অবাক লাগে যখন দেখি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তারা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নৌকা প্রতীকের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন। এসব সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনকে বাধাগ্রস্ত করবে। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় রেজিস্ট্রার ও দুই সরকারি কর্মকর্তাকে রিটার্নিং কর্মকর্তা নোটিশ দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দুঃখপ্রকাশ করে লিখিতভাবে জবাব দিয়েছেন। কিন্তু এটাই কি সমাধান? তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। এ ছাড়া সংসদ সদস্যরা প্রকাশ্যে সরকারদলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালালেও তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, একটা সতর্কতামূলক নোটিশ পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।

প্রশ্ন:

আপনি কি রিটার্নিং কর্মকর্তার ভূমিকা যথাযথ মনে করছেন না?

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী: অবশ্যই না। রিটার্নিং কর্মকর্তা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এবং দুই সরকারি কর্মকর্তাকে আচরণবিধি লঙ্ঘনের জন্য নোটিশ দিয়েছেন, এ জন্য তাঁকে ধন্যবাদ। তবে নির্বাচনে সুষ্ঠু ও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিতের জন্য তাঁর আরও কঠোর হওয়া প্রয়োজন। যেসব সংসদ সদস্য প্রচারণা চালাচ্ছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বিধি ভেঙে যেসব প্রার্থী নির্বাচনী গণসংযোগ করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। প্রতিদিনই পত্রপত্রিকায় প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণার ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, টিভি চ্যানেলগুলোতে তাঁদের প্রচারণার সংবাদ দেখানো হচ্ছে। নিশ্চয়ই সেসব রিটার্নিং কর্মকর্তার দৃষ্টি এড়াচ্ছে না। তাহলে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনায় ব্যবস্থা কেন নেওয়া হচ্ছে না? এ ছাড়া রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মাত্র এক দিন নগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান সড়ক থেকে প্রার্থীদের রঙিন বিলবোর্ড অপসারণ করা হয়েছিল। এখনো নগরের ৪২টি ওয়ার্ডের প্রায় সব কটি পাড়া-মহল্লায় ব্যানার, পোস্টার, বিলবোর্ডসহ নানা প্রচারসামগ্রী সাঁটানো আছে। এসব অপসারণেও কোনো উদ্যোগ নেই।

প্রশ্ন:

বিএনপি তো নির্বাচনে নেই। তবে বিএনপির মনোনয়নে টানা দুবার মেয়র নির্বাচিত হওয়া আরিফুল হক চৌধুরী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে গুঞ্জন আছে। যদিও ২০ মে তিনি জনসভা করে প্রার্থিতার বিষয়টি স্পষ্ট করবেন বলে জানিয়েছেন। তবে সম্প্রতি মেয়র অভিযোগ করছেন, ইভিএমে ভোট কারচুপি হতে পারে। বিনা নোটিশে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার সদস্যদের প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। এসব বিষয়ে কী বলবেন?

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী: ইভিএমে ভোট নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কারণ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট নেওয়া হবে না, সেখানে স্থানীয় সরকারের একটা নির্বাচনে এ পদ্ধতির ব্যবহার অগ্রহণযোগ্য। এ ছাড়া ভোটারেরা ইভিএমের ভোট নিয়ে সন্দিহান। আর বিএনপি-দলীয় মেয়র যেসব অভিযোগ এনেছেন, তা গুরুতর। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বার্থে বর্তমান মেয়রের অভিযোগগুলো সরকার ও নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে, এমন কোনো ঘটনা ঘটতে দেওয়া উচিত নয়।

প্রশ্ন:

এই অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের আশা করেন কী?

ফারুক মাহমুদ চৌধুরী: বর্তমানে নির্বাচনের যে পরিবেশ চলছে, এসব দেখে আমার মনে হয় না জনকল্যাণে নিবেদিত কোনো ব্যক্তি প্রার্থী হবেন। তবে এখনো অনেক সময় বাকি। আমরা বিশ্বাস রাখতে চাই, সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু একটা নির্বাচন উপহার দেবে নির্বাচন কমিশন। তবে এর আগে সব প্রার্থী ও ভোটারকে আস্থায় নিয়ে আসতে হবে। যত বড় ব্যক্তিই আচরণবিধি লঙ্ঘন করুন না কেন, তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। আইন কেবল কাগজে থাকলে হবে না, যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে।