সাত মাস পর সেন্ট মার্টিনে আনন্দ–উচ্ছ্বাসের রাত

কক্সবাজার থেকে প্রথম দফায় এমভি কর্ণফুলী জাহাজে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে এসেছেন ৭৫০ জন পর্যটক। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেন্টমার্টিন জেটি ঘাটে
ছবি: প্রথম আলো

প্রায় সাত মাস পর পর্যটকদের পদচারণে মুখর প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। কক্সবাজার শহর থেকে আজ বৃহস্পতিবার সকালে এমভি কর্ণফুলী জাহাজে ওই দ্বীপে বেড়াতে গেছেন ৭৫০ জন পর্যটক। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পর্যটকবাহী জাহাজটি সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জেটিঘাঁটে পৌঁছায়।

বেলা সাড়ে তিনটার দিকে মাত্র ১২ জন পর্যটক নিয়ে এমভি কর্ণফুলী আবার সেন্ট মার্টিন থেকে কক্সবাজারের দিকে রওনা দেয়। টানা সাত মাস পর সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রথম রাত কাটানোর সুযোগ পেলেন এমভি কর্ণফুলীতে চড়ে যাওয়া অবশিষ্ট ৭৩৮ জন পর্যটক। আনন্দ–উচ্ছ্বাসে কাটছে তাঁদের সময়।

পর্যটকদের অধিকাংশই ওঠেন সৈকত তীরের ব্লু মেরিন, প্রাসাদ প্যারাডাইস, প্রিন্স হ্যাভেন, লাবিভা রিসোর্ট, নীলদিগন্ত, সীমানা পেরিয়ে, সমুদ্রবিলাসসহ বিভিন্ন হোটেল–রিসোর্ট–কটেজে। হোটেল থেকে বের হয়ে পর্যটকেরা নেমে পড়েন সৈকতে। কেউ কেউ সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জলে নেমে গোসলে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, টানা সাত মাস সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত বন্ধ ছিল। আজ বৃহস্পতিবার প্রথম দফায় সাত শতাধিক পর্যটক দ্বীপে রাত যাপনের সুযোগ পেয়েছেন। পর্যটকেরা দুপুরে এক দফা সৈকতে ঘোরাঘুরি এবং সমুদ্রস্নান সেরে হোটেলে ওঠেন। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেল চারটার দিকে আবার হোটেল থেকে সৈকতে বেরিয়ে পড়েন। বেশির ভাগ পর্যটক বালুচরে ঘোরাঘুরি করেন। বিশেষ করে দ্বীপের পশ্চিম সৈকতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা পাথরের স্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে পশ্চিমাকাশে অস্তগামী সূর্যের সঙ্গে সেলফি তোলার হিড়িক পড়ে যায় সন্ধ্যায়। হোটেলভাড়া ও রেস্তোরাঁগুলোতে খাবারের দাম যেন অতিরিক্ত আদায় না হয়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দ্বীপে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ও কটেজ রয়েছে ১৪৪টির মতো। এসবে প্রায় দুই হাজার পর্যটকের থাকার ব্যবস্থা আছে।

ইউপি চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান আরও বলেন, ইতিমধ্যে সব হোটেলে ৮০ শতাংশ কক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। আগামীকাল শুক্রবার আরও সাত শতাধিক পর্যটকের সমাগম ঘটতে পারে এই দ্বীপে।

হোটেলমালিকেরা বলেন, টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকায় দৈনিক পাঁচ হাজারের বেশি পর্যটক কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন যেতে পারছেন না। টেকনাফের নাফ নদীতে ডুবোচর সৃষ্টি হওয়া ও নাব্যতা–সংকটের কারণে প্রশাসন গত ২৮ সেপ্টেম্বর থেকে টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখে। এক যুগের বেশি সময় ধরে এই নৌপথে চলাচল করছে ১০টির বেশি প্রমোদতরি (জাহাজ) ও ৫০টির বেশি কাঠের ট্রলার ও দ্রুতগতির জলযান স্পিডবোট।

সেন্ট মার্টিনের বাজারপাড়ার ইজিবাইক (টমটম) চালক মো. আলমগীর (৪৫) বলেন, পর্যটক না থাকায় গত সাত মাস তিনি বেকার ছিলেন। বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে তিনি টমটম চালাচ্ছেন। বিকেল চারটা পর্যন্ত ৭০০ টাকা আয় করেছেন।
দ্বীপের হোটেলমালিক আবদুর রহমান বলেন, পর্যটকেরা সৈকতে ভ্রমণের পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছকে গ্রিল করে খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কেউ কেউ কাঁকড়া ও লবস্টার খাচ্ছেন। হোটেল–রেস্তোরাঁতে রকমারি সামুদ্রিক মাছের মজুত রাখা হয়েছে। তবে মাছের দাম আগের তুলনায় কিছুটা বেশি পড়ছে।

রাজধানীর বাড্ডা থেকে প্রথম সেন্ট মার্টিনে ঘুরতে এসেছেন মনছুর-সাবরিনা দম্পতি। ওঠেন দ্বীপের পশ্চিম পাশের বালিয়াড়িতে নির্মিত প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বাংলোবাড়ি ‘সমুদ্র বিলাসে’র একটি রিসোর্টে। রিসোর্ট থেকে পা ফেললেই পাথুরে সৈকত।

আবুল মনছুর (৩৬) বলেন, সন্ধ্যায় যখন লাল আভা ছেড়ে সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অস্ত যাচ্ছিল, তখন দৃশ্যটা দারুণ উপভোগ্য ছিল। মনে হয় সূর্যটা সাগরে ডুবে যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে সৈকতে কাঁচা সামুদ্রিক মাছ ও কাঁকড়া ভেঁজে বেচাবিক্রির হাট বসে। রিসোর্ট কাছাকাছি হওয়ায় গভীর রাতেও সৈকতে নামার সুযোগ আছে।

সাবরিনা বলেন, এমভি কর্ণফুলীতে চড়ে তাঁরা কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিন এসেছেন। গভীর সমুদ্রের অভিজ্ঞতাও সারা জীবন মনে রাখার মতো।

এমভি কর্ণফুলী জাহাজের কক্সবাজারের পরিচালক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর প্রথম আলোকে বলেন, আজ সকাল সাতটায় এমভি কর্ণফুলী কক্সবাজার থেকে ৭৫০ জন পর্যটক নিয়ে সেন্ট মার্টিন যায়। বেলা তিনটার দিকে মাত্র ১২ জন পর্যটক নিয়ে জাহাজটি কক্সবাজারের উদ্দেশে সেন্ট মার্টিন ত্যাগ করে। সেন্ট মার্টিনে রাত যাপনের জন্য থেকে গেছেন ৭৩৮ জন পর্যটক। কাল শুক্রবার সকালে এমভি কর্ণফুলী কক্সবাজার থেকে আরও ৭ শতাধিক পর্যটক নিয়ে সেন্ট মার্টিন যাবে। দ্বিতীয় দিনেও সাত শতাধিক পর্যটক সেন্ট মার্টিনে রাত যাপনের জন্য সেখানে থেকে যেতে পারেন।

জাহাজমালিকদের সংগঠন ‘সি-ক্রুজ অপারেটরস ওনার্স  অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ ( স্কোয়াব)’ সভাপতি তোফায়েল আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে প্রতিবছর ২০-২৫ লাখ পর্যটক আসেন। এর মধ্যে ৭০ ভাগের আগ্রহ থাকে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের। এখন একটিমাত্র জাহাজে কক্সবাজার থেকে সেন্ট মার্টিনে সাত শতাধিক পর্যটকের যাতায়াতের সুযোগ হচ্ছে। হাজারো পর্যটক সেন্ট মার্টিন যেতে না পেরে হতাশ। তাতে পর্যটনশিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এখন টেকনাফ থেকে বিকল্প পথে সেন্ট মার্টিনে জাহাজ চলাচল শুরু করার চেষ্টা চলছে।