দ্রব্যমূল্যের প্রভাবে উভয় সংকটে ফুটপাতের ও খাবার হোটেলের ব্যবসায়ীরা

দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধিতে লোকসান থেকে বাঁচতে তেলেভাজা খাবারের দাম বাড়িয়ে বিপাকে পড়েছেন ফুটপাতের ব্যবসায়ী নরেশ দাস। পাবনার বেড়া বাজারে
ছবি: প্রথম আলো

পাবনার বেড়া উপজেলা সদরের বাজারে ফুটপাতে তেলেভাজা খাবার বিক্রি করেন নরেশ দাস। সাত-আট মাস আগে তিনি প্রতি জোড়া শিঙাড়া, পুরি, আলুর চপ বা সবজির চপ বিক্রি করতেন পাঁচ টাকায় (প্রতিটি আড়াই টাকা)। এসব খাবার তৈরির উপকরণের (তেল, ডাল, আটা) দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে গেছে। এ কারণে বাধ্য হয়ে তিনি প্রতি জোড়া শিঙাড়া, পুরি, চপ ১০ টাকা (প্রতিটি ৫ টাকা) করে বিক্রি করছেন। আর এতেই বিপাকে পড়েছেন নরেশ দাস। ক্রেতার অভাবে দোকান চালু রাখাই মুশকিল হয়ে পড়েছে তাঁর। অথচ কয়েক দিন আগেও দোকানের সামনে ভিড় থাকত।

বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যেই দোকান বন্ধ রাখছেন জানিয়ে নরেশ দাস প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর দোকানের খাবার তৈরির মূল উপকরণ সয়াবিন তেল, আটা, বেসন। সঙ্গে এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) গ্যাসের (সিলিন্ডার) খরচও রয়েছে। গত এক বছরে এগুলোর প্রতিটির দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। খাবারের দাম না বাড়িয়ে আকার ছোট করেছিলেন। এতে ক্রেতারা অসন্তুষ্ট হন। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাই খাবারের দাম বাড়িয়েছেন। কিন্তু এখন ক্রেতা একেবারেই কমে গেছে।

সব মিলিয়ে উভয় সংকটে আছেন নরেশ দাস। তিনি আরও বলেন, ‘আগে যেখানে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা বিক্রি হতো, সেখানে এখন এক হাজার টাকাও বিক্রি হয় না। আগে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা প্রতিদিন লাভ থাকত। এখন দেড় থেকে ২০০ টাকা লাভ থাকে। এই আয়ে সংসার চালানো যাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে মাঝেমধ্যে দোকান বন্ধ রেখে অন্য পেশার খোঁজ করছি।’

শুধু নরেশ দাস নন, বেড়া উপজেলার ফুটপাতে তেলেভাজা খাবার বিক্রেতা ও খাবার হোটেল ব্যবসায়ীদের সবারই একই অবস্থা। খাবার তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে অনেকেই খাবারের দাম বাড়িয়েছেন। এতে লোকসান সামাল দেওয়া গেলেও তেমন লাভ হচ্ছে না। উল্টো ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে।

এমন অন্তত ১০ হোটেলমালিক ও ফুটপাটের দোকানির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।

তাঁদের ভাষ্য, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষই তাঁদের খাবারের দোকানের মূল ক্রেতা। কিন্তু চরম অর্থনৈতিক সংকটে থাকায় তাঁরা ১০ বা ২০ টাকা বাঁচানোর বিষয়টিকেও গুরুত্ব দিচ্ছেন। আগে যেখানে অনেকেই বাড়িতে তিনবেলা খাবার ছাড়াও দিনে অন্তত দুইবার বাজারে এসে হালকা খাবার খেতেন। এখন তাঁরা তা না করে টাকা বাঁচানোর জন্য একবারে বাড়িতে গিয়ে খাবার খাচ্ছেন।

বেড়া বাজারে ছোট একটি খাবার হোটেল রয়েছে এনামুল হকের। শিঙাড়া, পুরি, নিমকি ও ছোলা বিক্রি করেন তিনি। তেলেভাজা এসব খাবার তৈরির উপকরণগুলোর দাম বেড়ে যাওয়ায় সম্প্রতি তিনিও খাবারের দাম বাড়িয়েছেন। এতে বিক্রির ওপর নেতিবাচব প্রভাব পড়েছে। সারা দিন বিক্রি করে তাঁর দেড় থেকে ২০০ টাকা লাভ হয়। অথচ আগে দিনে ৭০০–৮০০ টাকা আয় থাকত।

এনামুল হক বলেন, ‘রিকশাচালক, বিভিন্ন দোকানের কর্মচারীসহ অনেকেই আমার দোকানে এসে কমপক্ষে ১০ টাকার শিঙাড়া, পুরি বা ছোলা খাইত। এখন টাকা বাঁচানোর জন্য তেমন একটা আসে না তারা। দোকানের বেচাকেনার যে অবস্থা, তাতে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো দোকান বন্ধ করে দিতে হবে।’

যা বেতন পান, তাতে সংসার চলে না। ফলে বিভিন্নভাবে টাকা বাঁচানোর চেষ্টা করেন বেড়া বাজারের একটি হার্ডওয়্যার দোকানের কর্মচারী তারেক হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগেও মাসে আট হাজার টাকা বেতন পাইতাম। এখনো বেতন একই আছে। অথচ চাল, ডালসহ প্রতিটি জিনিসের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় আগের মতো শিঙাড়া, পুরি খাওয়ার আর উপায় নাই। দৈনিক ১০ টাকার শিঙাড়া, পুরি না খাইলে মাসে সংসার খরচের অন্তত ৩০০ টাকা বাঁইচ্যা যায়।’

বেড়া উপজেলা শহরের বনলতা সুইটস অ্যান্ড হোটেলের পরোটা বিখ্যাত। তেল, আটার দাম বাড়ায় সাত-আট মাস হলো হোটেল কর্তৃপক্ষ পরোটা তৈরি পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছে। হোটেলের ব্যবস্থাপক পলাশ পাল বলেন, পরোটা তৈরির উপকরণ কেনার খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে এটি বানানো বন্ধ করেছেন।

নিত্যপণ্যের দাম এখন নিম্নবিত্তের ধরাছোঁয়ার বাইরে বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) পাবনা শাখার সভাপতি এ বি এম ফজলুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনেকেই আগে সকালের নাশতাসহ দুপুর ও সন্ধ্যার হালকা নাশতা হোটেল–রেস্তোরাঁয় করতেন। এখন ইচ্ছা থাকলেও টাকা বাঁচাতে তাঁরা হোটেলবিমুখ হয়েছেন।