গর্জন বনে ট্রি অ্যাডভেঞ্চার, এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা

কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানে দুই পর্যটক রশির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। সাম্প্রতিক ছবি
প্রথম আলো

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা এলাকা। মহাসড়কের দুই পাশে ৩৯৫ দশমিক ৯২ হেক্টর আয়তনের বনাঞ্চল নিয়ে গড়ে উঠেছে মেধাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান। উদ্যানের ভেতরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত আট হাজার গর্জনগাছ। গাছে গাছে বানরের লাফালাফি, পাখির কিচিরমিচির আওয়াজ। নিচে শিয়ালসহ বিভিন্ন বন্য প্রাণীর দৌড়ঝাঁপ।

এমন পরিবেশে রশিতে ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক গাছ থেকে অন্য গাছ হয়ে বনাঞ্চল ঘুরে দেখার সুযোগও মিলছে। বন অধিদপ্তরের আওতাধীন কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ মেধাকচ্ছপিয়ার জাতীয় উদ্যানের ভেতরে ইকো অ্যাডভেঞ্চার বা ট্রি অ্যাডভেঞ্চারের নানা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। তাঁদের দাবি, এটি দেশের প্রথম ইকো অ্যাডভেঞ্চার। বন বিভাগের সহযোগিতায় ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি ট্রি অ্যাডভেঞ্চার চালু করে ইউএসএআইডির নেচার কনজারভেটিভ ম্যানেজমেন্ট (নেকম)–ক্রেল প্রকল্প।

গত ২১ আগস্ট দুপুরে সরেজমিন দেখা গেছে, ট্রি অ্যাডভেঞ্চারের জন্য গর্জনগাছের মধ্যভাগে (প্রায় ৫০ ফুট উঁচুতে) রোপওয়ে (রশির রাস্তা) নির্মাণ করা হয়েছে। টিকিটের বিনিময়ে দর্শনার্থীরা রোপওয়েতে উঠে হেঁটে এদিক-সেদিক ছুটছেন। আর নিচে দাঁড়িয়ে হইহুল্লোড় করে মজা নিচ্ছেন অন্যরা।

স্ত্রী ও দুই ছেলে–মেয়েকে নিয়ে ট্রি অ্যাডভেঞ্চারের অভিজ্ঞতা নিতে এসেছেন চট্টগ্রামের বহদ্দার এলাকার ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম। প্রথমে সাইফুল ইসলাম সিঁড়ি দিয়ে ৫০ ফুট উঁচু গাছের মধ্যভাগে ওঠেন। তারপর রোপওয়ের রশি দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেন। সাইফুলের শরীর মোটা রশি দিয়ে তারের সঙ্গে বাঁধা। কোনো কারণে রশি থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে যেন শরীরে আঘাত যেন না পায়, সে জন্য শরীর বেঁধে রাখা হয়। নিচে অপেক্ষমাণ স্বজনেরা মুঠোফোনে ধারণ করেন সাইফুলের এ ‘রশিযাত্রা’। তবে সাইফুল বেশি দূর যেতে পারলেন না।

সাইফুল ইসলাম (৪৮) বলেন, ‘ট্রি অ্যাডভেঞ্চার সহজ মনে হলেও আসলে কঠিন ব্যাপার। শারীরিক ফিটনেস না থাকলে অ্যাডভেঞ্চার করা কঠিন।’

কিছুক্ষণ পর গাছে ওঠেন কলেজপড়ুয়া মনজুরুল ইসলাম (২০)। ২০ মিনিটের মাথায় রশির রাস্তা অতিক্রম করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। মনজুরুল বলেন, ট্রি অ্যাডভেঞ্চার করতে সাহস লাগে। প্রথমে তিনিও ভয় পেয়েছিলেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সবকিছু স্বাভাবিক মনে হয়েছে। ট্রি অ্যাডভেঞ্চার দারুণ আনন্দের, রোমাঞ্চকর।

রশিতে ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এক গাছ থেকে অন্য গাছ হয়ে বনাঞ্চল ঘুরে দেখার সুযোগও মিলছে
ছবি: প্রথম আলো

উদ্যানসংশ্লিষ্ট লোকজন বলেন, ট্রি অ্যাডভেঞ্চারের পাশাপাশি সাইক্লিং, হ্রদে বোটিং, ফিশিং, টি-হাউস, ইকো হাউস, তাঁবু জলসা, গাছে ঝোলা, হাইকিং, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে উঠে বিশাল গর্জন বন দেখার সুযোগ রাখা হয়েছে।

কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. আনোয়ার হোসেন সরকার বলেন, মেধাকচ্ছপিয়ার জাতীয় উদ্যানের এই ইকো টুরিজম প্রকল্প পর্যটকদের বিনোদনের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। পাশাপাশি বনাঞ্চলও রক্ষা হচ্ছে। ট্রি অ্যাডভেঞ্চার করতে আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার জন্য সেখানে ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইচ্ছা করলে কেউ বনের ভেতরে রাত্রি যাপনও করতে পারেন। জাতীয় উদ্যানের ভেতরে লেক খনন, রাস্তাসহ নানা অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে জাতীয় উদ্যানকে আরও আকর্ষণীয় করা হচ্ছে।

বনাঞ্চলের ভেতরে গড়ে তোলা এই ট্রি অ্যাডভেঞ্চার দেশের প্রথম প্রকল্প দাবি করে নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, প্রতিদিন শতাধিক মানুষ ভ্রমণের এই নতুন অভিজ্ঞতা-রোমাঞ্চ উপভোগ করছেন। সেপ্টেম্বর মাস থেকে পর্যটন মৌসুম শুরু হবে, তখন দর্শনার্থীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।

বনকর্মীরা বলেন, এখানকার বনের প্রকৃতি হলো ক্রান্তীয় চিরহরিৎ বন। জাতীয় উদ্যান প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য—শতবর্ষী গর্জন বন রক্ষা করা। এই উপমহাদেশে যে অল্প কিছু গর্জন বন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, মেধাকচ্ছপিয়া বন তার অন্যতম। এখানে প্রধান বৃক্ষরাজির মধ্যে বিশালাকৃতির গর্জন ছাড়াও আছে ঢাকিজাম, ভাদি, তেলসুর ও চাপালিশ গাছ। উদ্যানে রয়েছে মেছো বাঘ, হাতি, বানর, উল্টো লেজ বানর, বনবিড়াল, বনমোরগ, শুশুক, ইগল, সবুজ ঠোঁট ফিঙে, চিল, শ্যামা, গুইসাপ, হ্যাজা সাপসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। পাশে রয়েছে ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক।

বনকর্মীরা আরও বলেন, বন রক্ষায় কো-ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যরা সহযোগিতা দিচ্ছেন। তবে প্রায় এক হাজার একর বনাঞ্চল রক্ষণাবেক্ষণের বিপরীতে মাত্র চারজন ফরেস্ট গার্ড আছেন। তাঁদের পক্ষে বিশাল বন পাহারা দেওয়া কষ্টকর।

বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০০৪ সালের ৪ এপ্রিল ৩৯৬ হেক্টর গর্জন বনকে ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণার সময় এই বনে শতবর্ষী মা গর্জনগাছ ছিল ১০ হাজার ৩৩৭টি। এখন আছে সাত হাজারের মতো। কয়েক শ গাছ ঘূর্ণিঝড়-প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভেঙে পড়েছে। কিছু গাছ চোরের দল কেটে নিয়েছে। কিছু গাছ বিষ প্রয়োগ করে মেরে ফেলা হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩৯৬ হেক্টর বনের অন্তত ৭৩ হেক্টর বনভূমি অবৈধ দখলে চলে গেছে। সেখানে তৈরি হয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি। এসব উচ্ছেদ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে।

সূত্রটি আরও জানায়, একটা সময় গর্জনগাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে নার্সারিতে চারা সৃজন করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হতো। এ জন্য গর্জন বনটি দেশের প্রথম ও একমাত্র মাদার গর্জন বন হিসেবে পরিচিত। ইকো অ্যাডভেঞ্চার প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে সংরক্ষণ হচ্ছে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য।