বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক
৩৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব
তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পে ৯টি জেলার ৩ হাজার ৩৮৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ থেকে জামালগঞ্জ উপজেলার দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। এবারের বন্যায় সড়কটির ১৪ কিলোমিটারই বিধ্বস্ত হয়। টানা পাঁচ দিন সড়কে ছিল কোমরপানি। পানি নামার পর সড়কে ভেসে ওঠে বন্যার ক্ষত। বড় বড় গর্ত আর খানাখন্দে ভরা সড়কে চলাচলে মানুষকে এখন চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
সুনামগঞ্জ-জামালগঞ্জ সড়কের মতো চলতি বছরের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক সংস্কারে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার প্রকল্প প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। সাড়ে তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পে ৯টি জেলার ৩ হাজার ৩৮৬ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এবার বন্যায় সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলোতে সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন জেলার এলজিইডি কার্যালয় থেকে সদর দপ্তরে পাঠানো প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করেছে সংস্থাটির রক্ষণাবেক্ষণ শাখা। প্রকল্পে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, শেরপুর, নেত্রকোনা, জামালপুর ও কুড়িগ্রাম জেলা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।
প্রকল্প প্রস্তাব ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলে এটি বাস্তবায়নের কাজ করবে এলজিইডি।এ এস এম মহসীন, রক্ষণাবেক্ষণ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী, সওজ প্রধান কার্যালয়
এলজিইডি সূত্র জানায়, প্রতিবছর এলজিইডির বাজেটে সড়ক ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ নির্দিষ্ট টাকা বরাদ্দ থাকে। অনেক সময় বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ে একাধিক জেলার সড়ক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের বরাদ্দ থেকে সংস্কার করা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতিতে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কের জন্য আলাদা প্রকল্প নেওয়া হয়।
এলজিইডির প্রধান কার্যালয়ের রক্ষণাবেক্ষণ শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী এ এস এম মহসীন প্রথম আলোকে বলেন, জেলার তথ্যের ভিত্তিতে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলোর মেরামত ও পুনর্নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সরকারের অনুমোদন পেলে এটি বাস্তবায়নের কাজ করবে এলজিইডি।
চলতি বছর স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয় সিলেট বিভাগে। এলজিইডির তথ্য অনুযায়ী, ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ও কালভার্টের বড় অংশই বিভাগের চার জেলায়। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি সড়ক। এর মধ্যে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ক্ষয়ক্ষতি বেশি।
সুনামগঞ্জ শহরের সুরমা নদীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুজ জহুর সেতুর পশ্চিম পাশের সংযোগ সড়ক থেকে ডান দিকে একটি সড়ক গেছে জেলার বিশ্বম্ভরপুর উপজেলায়। একই স্থান থেকে বাঁ দিকে
সড়ক সংস্কার না হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। আমাদের দাবি, দ্রুত সড়ক সংস্কারের। একই সঙ্গে কাজটি যেন মানসম্মত হয়।ইকবাল আল আজাদ, চেয়ারম্যান, জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদ, সুনামগঞ্জ
আরেকটি সড়ক গেছে জামালগঞ্জ উপজেলায়। এই সড়ক দিয়ে জামালগঞ্জের সাচনা বাজার হয়ে জামালগঞ্জ ও ধর্মপাশা উপজেলার মানুষ জেলা সদরে যাতায়াত করেন। আর বিশ্বম্ভরপুর যে সড়কটি গেছে সেটি হয়ে জেলা সদরে যাতায়াত করেন তাহিরপুর উপজেলার লোকজন। এই দুটি সড়কই বন্যায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইকবাল আল আজাদ বলেন, ‘বন্যার পর এখনো সড়ক সংস্কার না হওয়ায় মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। আমাদের দাবি, দ্রুত সড়ক সংস্কারের। একই সঙ্গে কাজটি যেন মানসম্মত হয়। এক বছর পর যেন আবার ভোগান্তিতে না পড়তে হয়।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর হয়ে তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর পর্যন্ত ১৭ কিলোমিটার সড়ক বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফতেপুর ইউনিয়নের অন্তত ১০টি গ্রামের মানুষ এই সড়ক দিয়ে সুনামগঞ্জ সদর এবং তাহিরপুরে যাতায়াত করেন। গত রোববার বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়ক ভেঙে নালার মতো সৃষ্টি হয়েছে। কোপাগাঙ এলাকায় একটি সেতুর দুই দিকের সংযোগ সড়ক বন্যার পানিতে ভেঙে গেছে।
হরিপুর গ্রামের বাসিন্দা আজিজুর রহমান বলেন, বন্যার পর এই সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরে সড়কের ভাঙা ও গর্ত হওয়া স্থানে কিছু ইট ফেলা হয়। এলাকার অটোরিকশা চালকেরা স্বেচ্ছাশ্রমে মেরামত করে কোনো রকমে গাড়ি চালাচ্ছেন। কোপাগাঙয়ের সংযোগ সড়কের যে অবস্থা তাতে যেকোনো সময় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের দাবি, প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদনের। তবে বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নেওয়া প্রকল্পটিতে পর্যাপ্ত টাকা পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ দুই বছর আগে ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নেওয়া একই ধরনের প্রকল্পটিতে বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে কম।
২০২০ সালের ২০ মে উপকূলীয় জেলাগুলোর ওপর আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। পরের মাসে শুরু হয় হয় বন্যা। এতে অনেক রাস্তাঘাট, সেতু ও কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ৫ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পান ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পল্লি সড়ক অবকাঠামো পুনর্বাসন (সিএএফডিআরআইআরপি)’ শীর্ষক প্রকল্প নেয় এলজিইডি। প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে ৬ হাজার কিলোমিটার সড়ক সংস্কার করার কথা। প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সিএএফডিআরআইআরপি প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বরাদ্দ আশানুরূপ পাওয়া যায়নি। ফলে প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করা সম্ভব হবে না। প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পে এখন পর্যন্ত ৯০০ কোটি টাকার মতো পাওয়া গেছে। প্রকল্পের অগ্রগতি ১৫ শতাংশের কম।