এত মৃত কাছিম কেন ভেসে আসছে, সাক্ষাৎকারে যা বললেন গবেষক

কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে একের পর এক মৃত কাছিম ভেসে আসছে। গত এক মাসে কক্সবাজার শহর, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন ও মহেশখালীর সোনাদিয়া সৈকত থেকে অন্তত ৮৮টি মৃত মা কাছিম উদ্ধার করা হয়েছে। অলিভ রিডলে প্রজাতির এসব কাছিমের সব কটির পেটে ডিম ছিল। এত বেশি সংখ্যায় কাছিমের মৃত্যু ভাবিয়ে তুলছে। এ নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরীর সঙ্গে।

প্রথম আলো:

কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত এলাকায় একের পর এক মৃত কাছিম ভেসে আসছে। সব কটি অলিভ রিডলে প্রজাতির। প্রাথমিকভাবে এভাবে কাছিম মারা যাওয়ার কারণ কী মনে হচ্ছে?

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: পৃথিবীতে সাত প্রজাতির সামুদ্রিক কাছিম আছে। তার মধ্যে পাঁচ প্রজাতির কাছিম বাংলাদেশে পাওয়া যায়। তিনটি প্রজাতি আমাদের উপকূলে ডিম দেওয়ার জন্য আসে। তাদের মধ্যে অন্যতম অলিভ রিডলে, গ্রিন বা সবুজ রঙের সামুদ্রিক কাছিম ও হকস বিল কাছিম। টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, কক্সবাজার, সোনাদিয়া ও কুয়াকাটায় এগুলো পাওয়া যায়।

এবার এতসংখ্যক কাছিমের মৃত্যুর পেছনে কয়েকটা কারণ আছে মনে হয়। সমুদ্রে প্রচুর পরিমাণে মাছ ধরা হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় আড়াই শ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার আছে, যেগুলো উপকূল থেকে দূরবর্তী সমুদ্র অঞ্চলে মাছ ধরে। ট্রল নেট (বড় টানা জাল) ব্যবহার করে। এসব মাছ ধরার ট্রলার বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় চষে বেড়ায়। ৪০ থেকে ৭০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাছ ধরে।

উপকূলের কাছাকাছি থেকে মাছ ধরে ৬৫ হাজারের বেশি ট্রলার, যারা গিল নেট বা ভাসমান ফাঁসজাল ব্যবহার করে। উপকূলের দিকে ডিম দিতে আসার সময় কিংবা গভীর সাগরে থাকার সময় জালে আটকে আঘাতপ্রাপ্ত হয় কাছিম। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত সাধারণত অলভি রিডলের ডিম পাড়ার সময়। ওই সময় লবণাক্ততা বেশি, পলির পরিমাণ কম ও পানি স্বচ্ছ থাকে। সাগরও তুলনামূলক কম উত্তাল থাকে। তাই কাছিমের উপকূলের দিকে আসার এটা অনুকূল সময়।

এ ছাড়া জাহাজ বা ট্রলারের আনাগোনা বাড়ার কারণে প্রপেলার কিংবা অন্য কিছুর ধাক্কায় আঘাত পায় কাছিম। এর পাশাপাশি অন্য প্রজাতি, বিশেষ করে হাঙরের মতো জলজ প্রাণীর আক্রমণেও মারা যেতে পারে। তবে তা বাংলাদেশ উপকূলে কতটা, তা গবেষণার বিষয়।

কাছিম মারা যাওয়ার আরেকটা কারণ হচ্ছে দূষণ। বিশেষ করে জেলেদের অনেক আবর্জনা সমুদ্রে পড়ে। ট্রলারের আবর্জনা, ছেঁড়া জাল, প্লাস্টিক, কর্কশিট, পোড়া তেলসহ নানা কারণে সাগর দূষিত হচ্ছে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

একটা বিষয় লক্ষণীয় যে মৃত সব কটিমা কাছিম। সব কটির পেটে ডিম পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কি উপকূলের কাছাকাছি এসে এগুলো কোনোভাবে মারা যাচ্ছে? নাকি গভীর সাগরে মারা যাওয়ার পর ভেসে আসছে?

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: আমাদের উপকূল ও গভীরে ৭০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মাছ ধরা হয়, আগেই বলেছি। তবে বেশির ভাগ মাছ ধরা হয় উপকূলের কাছাকাছি, ভাসা জাল দিয়ে। কাছিমগুলো যখন ডিম পাড়ার জন্য উপকূলের দিকে আসছে, তখন তারা বিভিন্নভাবে এই মাছ ধরার জালে আটকা পড়ছে। আটকা পড়া অবস্থায় জালটা যদি বেশিক্ষণ পানিতে থাকে, তখন কাছিমটা মারা যাওয়ার শঙ্কা বেশি। কাছিম দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকতে পারে না।

জাল বা প্রপেলারে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার পর কাছিম ঢেউয়ের কারণে ভাসতে ভাসতে উপকূলের দিকে চলে আসে। সেখানে মারা যায়। আবার সুস্থ অবস্থায় ডিম পাড়তে আসার পর কুকুরের আক্রমণেও মারা যেতে পারে।

প্রথম আলো:

অলিভ রিডলে প্রজাতির কাছিমের প্রজননকাল, জীবনকাল, আকার ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে যদি বলেন...

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: অলিভ রিডলের প্রজননকাল নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত। আমাদের এখানে যেসব উপদ্রবের ঘটনা, সেগুলোও এই সময়টাতে বেশি। গ্রিন কাছিম জুন থেকে নভেম্বরে আসে। হকস বিল কাছিমও অলিভ রিডলের মতো একই সময়ে উপকূলের দিকে আসে। সামুদ্রিক কাছিম কূলে আসার আরও একটা কারণ হচ্ছে তাদের খাবার। সামুদ্রিক শৈবাল ও নরম প্রবালসহ নানা রকমের ছোট জলজ প্রাণী খেয়ে থাকে তারা।

অলিভ রিডলের ওজন ৪৫ থেকে ৫৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। তারা ৫০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত বাঁচে। ডিম দিয়ে তারা কূলে থাকে না। আকারের ওপর ডিমের পরিমাণও নির্ভর করে।

অলিভ রিডলে কাছিম যতগুলো ডিম পাড়ে, তার মধ্যে ৫৭ শতাংশ ডিমের বাচ্চা ফোটে। বাচ্চা ফোটানোর জন্য ৫৫ থেকে ৬০ দিনের মতো সময় লাগে। এটা তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর নির্ভর করে। সময় বেশিও লাগতে পারে।

প্রথম আলো:

বঙ্গোপসাগরে কাছিমের সংখ্যা ও প্রজাতি নিয়ে কোনো কাজ অতীতে হয়েছে কি? আইইউসিএন তালিকা অনুযায়ী বিপন্ন তালিকায় কোনগুলো আছে?

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: ইউএনডিপির বাংলাদেশ অফিস গত বছর একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ২০১০ সালের দিকে সেন্ট মার্টিন থেকে ৬০টি কাছিম ডিম পাড়ার জন্য এসেছিল। কিন্তু ২০২০ সালে এটা ১৫ থেকে ২০টিতে নেমে আসে। গত দুই বছরে ১০ থেকে ১২টি কাছিমের বেশি আসেনি।

হকস বিল প্রজাতি অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া অলিভ রিডলে প্রজাতি ঝুঁকির মধ্যে আছে। গ্রিন বা সবুজ রঙের কাছিমের অবস্থান বিপন্ন। আর হকস বিল প্রজাতি মহাবিপন্ন অবস্থায় আছে। সামুদ্রিক কাছিম নিয়ে কিছু কাজ হয়েছে। এখনো হচ্ছে। কাছিমের ভৌগোলিক অবস্থানসহ নানা বিষয়ে গবেষণার আরও সুযোগ আছে।

প্রথম আলো:

এভাবে কাছিম মারা যাচ্ছে দিনের পর দিন। এ অবস্থায় প্রশাসন বা বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট কিংবা অন্য কোনো দপ্তরের কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: আমি মনে করি, প্রথমে কাছিম কোথায়, কখন আসছে, তা পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এ ছাড়া মারা যাওয়ার কারণ খতিয়ে দেখা দরকার। গবেষকেরা কিংবা জলজ এসব প্রাণী নিয়ে যারা কাজ করেন, তাঁরা জানেন অতীতে এসব কাছিম কোথায় কোথায় এসেছিল। ওই সৈকতগুলো আগে নিরাপদ করা দরকার, যাতে তারা ডিম পেড়ে আবার সমুদ্রে ফিরে যেতে পারে।

ডিম সংগ্রহ করে হ্যাচারির মাধ্যমে ফোটানোর ব্যবস্থা করা যায়। তাহলে পুরুষ ও স্ত্রী কাছিমের সংখ্যার ভারসাম্য থাকবে। কাছিম রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে সচেতন ও সম্পৃক্ত করতে হবে। মেরিন ফিশারিজ অরডিন্যান্স-১৯৮৩ ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২–এর যথাযথ প্রয়োগ দরকার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করে কাজ করা যায়।

প্রথম আলো:

কাছিমের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি মৃত ডলফিনও ভেসে এসেছে। আগেও ডলফিন ও তিমি মারা গেছে। সম্প্রতি অতি বিপন্ন পরপইসের একটা বাচ্চাও ভেসে এসেছে। সব মিলে পরিস্থিতি কেমন মনে হচ্ছে?

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে ভালো নয়। ডলফিন, পরপইস, কাছিম, তিমি—এগুলো একটা ইকোসিস্টেমের সূচক। কোনো একটা ইকোসিস্টেমে যদি এগুলো থাকে, তাহলে বলা যায় পরিস্থিতি ভালো আছে। কিন্তু এখন এসব প্রাণীর ওপর যখন হুমকি আসে, তখন বুঝতে হবে ইকোসিস্টেম ভারসাম্যহীন হচ্ছে। মনুষ্যসৃষ্ট ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমনটা হচ্ছে।

আমাদের প্রায় চার রকমের ডলফিনের আধিক্য উপকূলে দেখতে পাওয়া যায়। এখানে পরপইসের যে বাচ্চা মারা গেছে, সেটা ইন্দো-প্যাসিফিক ফিনলেস পরপইস। এসব প্রাণী এভাবে মারা গেলে আমাদের মন খারাপ হয়। তবে এর মধ্যে কাছিম বেশি ঝুঁকিতে। কারণ, তারা ধীরগতিতে সাঁতার কাটে। ডলফিন দ্রুতগতিতে পরিস্থিতি অনুযায়ী সরে যেতে পারে।

প্রথম আলো:

আঘাতের কারণ ছাড়া অন্য কোনো কারণ আছে এসব প্রাণীর মৃত্যুর পেছনে?

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: আঘাত, জলবায়ু পরিবর্তন, দূষণ ছাড়াও বয়সের কারণে অনেক সময় কাছিম মারা যেতে পারে।

প্রথম আলো:

ইলিশের জন্য আমরা প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা বন্ধ রাখি। সামুদ্রিক এসব প্রাণী বাঁচানোর ক্ষেত্রে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় কি? কিংবা প্রাণীগুলো রক্ষায় কী পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি বলে মনে করছেন?

শাহনেওয়াজ চৌধুরী: কাছিম অত্যন্ত মাইগ্রটোরি প্রজাতির। এক জায়গায় স্থির থাকে না। সাগর-মহাসাগরব্যাপী তারা ঘুরে বেড়ায়। এগুলো আমাদের পরিবেশের জন্য যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ, তাই কাছিমের সংরক্ষণের জন্য সমুদ্র উপকূলীয় দেশগুলো মিলে একটা যৌথ কনভেনশন করা যায় কি না, দেখা দরকার। এ ছাড়া জাতীয়ভাবে কাছিম সংরক্ষণে নজর দেওয়া উচিত। যেমন পানামা ইতিমধ্যে প্রথম দেশ হিসেবে সামুদ্রিক কাছিম সুরক্ষায় আইন করেছে। আমরাও চাইলে এ রকম একটা আইন করতে পারি।

আবার আন্তর্জাতিক আইনের বাধ্যবাধকতাও আছে এখানে। কনভেনশন অব বায়োলজিক্যাল ডায়ভার্সিটি বাংলাদেশ ১৯৯২ সালে স্বাক্ষর করে। তাই আমাদের দায়িত্ব জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। এরপর ২০১২ সালে বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন করা হয়। বাংলাদেশে তিনটি মেরিন প্রোটেক্টেড বা সমুদ্রের সংরক্ষিত এলাকা আছে। আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুযায়ী, সমুদ্র এলাকার ১০ শতাংশ জায়গাকে আমাদের সংরক্ষণ করতে হবে। দেশে তিনটি সমুদ্রের সংরক্ষিত এলাকা আছে। এখনো ১০ শতাংশ হয়নি আমাদের। এখানে কাছিমটা অগ্রাধিকার পেতে পারে।

সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনকে সমুদ্রের সংরক্ষিত এলাকা করা হয়েছে। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ জীববৈচিত্র্যের জন্য একটা হটস্পট। ওখানে প্রায় ১৭৪৩ বর্গকিলোমিটার সংরক্ষিত এলাকা। মাছ ধরার ক্ষেত্রে আরও কিছু নিয়ন্ত্রণ দরকার বলে মনে হয়। এতে কাছিমসহ পরিবেশের জন্য প্রয়োজনীয় জলজ প্রাণীর জীবন রক্ষা পাবে।