জালিয়াতি করে শতবর্ষী খেলার মাঠ দখলের চেষ্টা, ভবন নির্মাণের সময় মাটিতে শুয়ে বাধা

রাজশাহীর তানোরে একটি খেলার মাঠ রক্ষার দাবিতে খনন যন্ত্রের সামনে শুয়ে পড়েন স্থানীয় একজন খেলোয়াড়। সোমবার দুপুরে উপজেলার গোকুল মথুরা খেলার মাঠে
ছবি. প্রথম আলো।

রাজশাহীর তানোরে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে শতবর্ষী একটি খেলার মাঠ দখল করে একটি মাদ্রাসার ভবনের নির্মাণকাজ ঠেকিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় ক্রীড়ামোদী জনতা। ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সময় অনেকে খননযন্ত্রের (ভেকু) সামনে শুয়ে পড়েন। আজ সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্থানীয় খেলোয়াড় ও জনগণের বাধার মুখে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হয়।

স্থানীয় ভূমি কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ওই মাঠের নাম গোকুল মথুরা খেলার মাঠ। বাংলাদেশ সরকারের আরএস খতিয়ানে মাঠটি উপজেলার মথুরা মৌজায় অবস্থিত। এর জেএল নম্বর ১৫৩। খতিয়ান নম্বর ৩৮। দাগ নম্বর ৯৩। শ্রেণি খেলার মাঠ। পরিমাণ ১ একর ৬ শতাংশ। মালিকের নাম হিসেবে গোকুল মথুরা ফুটবল ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক (সেক্রেটারি) বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে খতিয়ানে ক্লাবের কোনো সাধারণ সম্পাদকের নাম উল্লেখ নেই।

আরও পড়ুন

সূত্রমতে, মাঠসংলগ্ন গোকুল মথুরা দাখিল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ১৯৯৯ সালের ৪ আগস্ট একটি দান দলিলের মাধ্যমে ৬ শতাংশ ও ওই বছরের ৮ আগস্ট একইভাবে দান দলিলের মাধ্যমে ৩৪ শতাংশ জমির মালিক হয়েছে। এর আগেই ১৯৮৩ সালের ৫ জুন গোকুল মথুরা প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একইভাবে একটি প্রতারণামূলক দান দলিলের মাধ্যমে ৬৬ শতাংশ জমির মালিক হয়েছে। এই তিনটি দলিলের মাধ্যমে অতি গোপনে মাঠের সব জমি গ্রাস করা হয়েছে। অথচ সেক্রেটারি হিসেবে ওই খতিয়ানে কারও নাম উল্লেখ ছিল না। অথচ আইন অনুযায়ী খেলার মাঠ কেউ হস্তান্তর বা অন্য কাজে ব্যবহার করতে পারে না।

মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০–এর ৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী খেলার মাঠ হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না বা এরূপ জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না বা অনুরূপ ব্যবহারের জন্য ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না। এ ছাড়া এসএ খতিয়ানেও মাঠটি গোকুল মথুরা ফুটবল ক্লাবের সেক্রেটারির নামেই ছিল।

সম্প্রতি স্থানীয় গোকুল মথুরা দাখিল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে চার তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণের প্রস্তুতি নিলে বিষয়টি জানাজানি হয়। বর্তমানে ক্লাবের সভাপতির নাম মো. রফিকুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশিদ। তাঁরা জানান, ভূমি কার্যালয়ে খোঁজ নিতে গিয়ে তাঁরা এই প্রতারণা মূল দলিলের সন্ধান পান। পুরো মাঠটি দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে খারিজ করেও নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর গত রোববার এই খারিজ বাতিলের জন্য ক্লাবের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর–রশিদ ওই খারিজ বাতিলের জন্য রাজশাহী জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছেন।

এর আগে ২ জুন মাঠের পক্ষ থেকে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ফুটবল ক্লাবের সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বাদী হয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৪৪ ধারায় একটি মামলা করেন। আদালত প্রতিপক্ষের জবাব দাখিল পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ১৮ জুন মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আদালতে জবাব দাখিল করেন। মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে আগামী ১০ জুলাই। এ বিষয়ে ৪ জুন রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ের উন্নয়ন শাখা থেকে রাজশাহী জেলা প্রশাসককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু এর আগেই মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণকাজ উদ্বোধনের প্রস্তুতি নিয়েছেন।

উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আজ সকালে মাদ্রাসার ভবনের নির্মাণের উদ্বোধন করতে যান। কিন্তু স্থানীয় লোকজনের বাধার মুখে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি। ঠিকাদারের লোকজন মাটি খননের চেষ্টা করলে স্থানীয় খেলোয়াড়েরা খননযন্ত্রের সামনে শুয়ে পড়েন। একপর্যায়ে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণের কাজ স্থগিত ঘোষণা করেন। বিকেলের দিকে ঠিকাদার লোকজন ও যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে যান।

জানতে চাইলে সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশে ওই ভবনের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। তাঁরা উদ্বোধন ঘোষণা করে আসেন, কিন্তু স্থানীয় লোকজন ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করতে দেয়নি বলে শুনেছেন।

এর আগে গত ১৪ এপ্রিল এলাকাবাসী ওই মাঠে একটি মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন। পরের দিন তানোর থেকে রাজশাহী জেলা পরিষদ কার্যালয় অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করেন। একই দিন ঘণ্টাব্যাপী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এবং জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। একই দাবিতে ২৫ মে রাজশাহীতে গোকুল মথুরা ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে স্বেচ্ছাসেবী যুব সংগঠন ‘স্বপ্নচারী যুব উন্নয়ন সংস্থা’ ও উন্নয়ন গবেষণাধর্মী যুব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ইয়ুথ অ্যাকশন ফর সোশ্যাল চেঞ্জ-ইয়্যাস’ রাজশাহীতে সংবাদ সম্মেলন করে।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট মো. আবদুল হামিদ রোববার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেন যে তাঁদের ভবন নির্মাণ করলে মাঠে খানিকটা অংশ ভবনের ভেতরে পড়বে। আজ আর ফোন ধরেননি। মুঠোফোনে কল করা হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত সালমানও রিসিভ করেননি। আর রাজশাহী জেলা প্রশাসক আফিয়া আখতার প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে তিনি অবগত আছেন। এ বিষয়ে তদন্ত করে যেটা সঠিক, সেটাই করা হবে।