কম খরচে মিলছে সেবা

গত কয়েক বছরের তুলনায় জেলায় হৃদ্‌রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে সচেতনতায় হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা।

  • এম আব্দুর রহিম হাসপাতালে গত এক বছরে কার্ডিওলজি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭ হাজার ৪৭৪ জন।

  • মারা গেছেন ৬৭৩ জন। যা শতকরা হিসাবে ৯ শতাংশ।

বিশ্ব হার্ট দিবস

দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের শয্যায় শুয়ে ছিলেন কৃষক মেহেরাব আলী (৬৫)। দীর্ঘসময় উচ্চ রক্তচাপ ও ‍বুকের ব্যথায় ভুগছিলেন। ২১ সেপ্টেম্বর বুকের ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে স্বজনরা তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করান। মলমূত্র, ইজিসি, ইকো পরীক্ষা শেষে চিকিৎসক জানান, তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রের দুটি জায়গায় ব্লক রয়েছে। রিং পরাতে হবে। পরের দিনই মেহেরাব আলীর হৃদ্‌যন্ত্রে দুটি রিং বসানো হয়। সুস্থ হয়ে ওঠেন মেহেরাব আলী। গতকাল বুধবারই হাসপাতাল থেকে তাঁকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে ওষুধপত্র, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রিং পরানোসহ সব মিলিয়ে মেহেরাব আলীর খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা। তিনি জানান, প্রথমে তাঁর স্বজনরা ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এক আত্মীয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ঢাকায় চিকিৎসা নিতে সব মিলিয়ে প্রায় তিন লাখ টাকা খরচ পড়বে তাঁর। তারপর সিদ্ধান্ত বদলে দিনাজপুরেই চিকিৎসা নিয়েছেন।

হৃদ্‌যন্ত্রের চিকিৎসার ক্ষেত্রে জেলার লোকজনের বড় ভরসাস্থল এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। শুধু দিনাজপুর নয়, রংপুর বিভাগের অনেকে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন। দিনাজপুরে এ হাসপাতালের পাশাপাশি জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশনও রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আজ বিশ্ব হার্ট দিবস পালন করা হচ্ছে। ২০০০ সাল থেকে এ দিবস পালন করা হয়। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় রাখা হয়েছে ‘হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে ভালোবাসুন, প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করুন’।

গত কয়েক বছরের তুলনায় জেলায় হৃদ্‌রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সে সঙ্গে বাড়ছে চিকিৎসার খরচ। তবে একটুখানি সচেতনতায় হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে জানার এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ খন্দকার আবু রুবাইয়াত। তিনি বলেন, হৃদ্‌রোগ একটি অসংক্রামক রোগ। আক্রান্তদের ৯৫ শতাংশই হয় চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিদের। আক্রান্ত ব্যক্তি সাধারণত ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ এবং শ্বাসকষ্টে ভোগেন। এ জন্য নিয়মিত ব্যায়াম, মানসিক চাপ এড়িয়ে যাওয়া, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ধূমপান পরিহার করতে হবে। এ ছাড়া প্রাণিজ উৎস হতে প্রাপ্ত ক্ষতিকারক স্নেহ খাবার না খাওয়া, রাত না জাগা, শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হলে হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়।

এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৭ হাজার ৪৭৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ৬৭৩ জনের। যা শতকরা হিসেবে ৯ শতাংশ। ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে অ্যানজিওগ্রাম করা হয়েছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ জনের। সাধারণ ওষুধে অনেকে সেরে উঠেছেন। কারও রিং পরানো হয়েছে, কারও বা অস্থায়ী পেসমেকার, কারও স্থায়ী পেসমেকার বসানো হয়েছে।

তবে মাঝে কিছুদিন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ক্যাথল্যাব বন্ধ থাকায় রিং পরানো বন্ধ ছিল। গত ১৭ আগস্ট পুনরায় তা চালু হয়। হাসপাতাল সূত্র বলছে, শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই ৬১৬ জন হৃদ্‌রোগী ভর্তি হয়। যার মধ্যে এনজিওগ্রাম হয়েছে ৮৪ জনের, পেসমেকার বসানো হয়েছে ৬ জনের আর রিং পরানো হয়েছে ৩ জনের।

হাসপাতাল সূত্রে আরও জানা যায়, ৮০ টাকায় ইসিজি পরীক্ষা, ২০০ টাকায় ইকো এবং ২ হাজার টাকায় অ্যানজিওগ্রাম করা হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেখানে রোগীর খরচ হয় ইসিজিতে ২৫-৩০০ টাকা, ইকো ১ হাজার টাকা, অ্যানজিওগ্রামের ক্ষেত্রে ১০-১৫ হাজার টাকা।

হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, কার্ডিওলজি বিভাগ খুবই স্পর্শকাতর একটা বিভাগ। হাসপাতালে ভালোমানের চিকিৎসার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতিও আছে। ৬২ শয্যার কার্ডিওলজি বিভাগ। অনেক সময় অতিরিক্ত রোগীও ভর্তি থাকে। প্রয়োজনের তুলনায় জনবলসংকট থাকায় চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয়। তিনটি ইউনিটে সর্বনিম্ন ১২ জন চিকিৎসক দরকার। সেখানে আছেন মাত্র ৪ জন। অন্যদিকে ইকো, ইটিটি, অ্যানজিওগ্রাম, ইসিজিসহ টেকনিশিয়ান পদে ২০ জনের বিপরীতে কাজ করছেন ৬ জন।

এদিকে গত ২৫ বছরেরও অধিক সময় ধরে হৃদ্‌রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে দিনাজপুর জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার। স্থানীয় ২৫ জন উদ্যোক্তা হৃদ্‌রোগের চিকিৎসাসেবা দিতে ১৯৯২ সালে গড়ে তোলেন প্রতিষ্ঠানটি। ১০০ শয্যার এই হাসপাতালটির ৫০ শয্যা হৃদ্‌রোগীদের জন্য। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও কার্ডিয়াক সার্জনের তত্ত্বাবধানে এখানে ৩৬ জনের ওপেন হার্ট সার্জারিও সম্পন্ন হয়েছে।

ফাউন্ডেশনের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক এ কে এম আজাদ জানান, অর্থের সংকুলান না হওয়া এবং মেশিন পুরোনো হওয়ায় ওপেন হার্ট সার্জারি বন্ধ আছে। তা চালু করার প্রক্রিয়া চলছে। তবে অন্য সেবা কার্যক্রম চলছে। আজ দিবস উপলক্ষে জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শোভাযাত্রা, সেমিনার ও ফ্রি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার আয়োজন করেছে।

জেলা সি‌ভিল সার্জন এ এইচ এম বোরহানুল ইসলাম সি‌দ্দিকী ব‌লেন, সাম্প্রতিক সময়ে জেলার প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে হৃদ‌্‌রোগী‌দের চিকিৎসাসেবার জন্য আলাদা কর্নারে বসানো হ‌য়ে‌ছে। এখান থে‌কে অনলাইনের মাধ্যমে দ্রুত সেবা দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় ওষুধও সরবরাহ করা হ‌চ্ছে। হৃদ্‌রোগ প্রতিরোধে প্রয়োজন সচেতনতা।