শত প্রতিবন্ধকতায় হার না–মানা মেয়েরা

জ্যোৎস্না খাতুনের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে কালিন্দী নদী। পরিবারের আয়-উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন এই নদী। পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মিলে আবার কোনো কোনো সময় একা জাল টেনেছে জ্যোৎস্না। মাছ বিক্রির সে টাকায় চালিয়ে নিয়েছে লেখাপড়া।

তরমিন আক্তারের বাবার সামর্থ্য ছিল না মেয়েকে পড়ানোর। মামার বাড়িতে রেখে যান মেয়েকে। আয়শা হক আর মীম আক্তারের পড়ালেখাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু শত প্রতিবন্ধকতা পার হয়ে তারা এসএসসি পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছে। চারজনই বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে।

মাছ ধরত জ্যোৎস্না

সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পারণপুর আব্দুর রউফ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের শিক্ষার্থী ছিল জ্যোৎস্না খাতুন। ভবিষ্যতে তার প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার ইচ্ছা। জ্যোৎস্না জানাল, কৈখালী গ্রামে তাদের বাড়ি। ভিটা ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই।

বাবা রেজাউল ইসলাম বললেন, দিন এনে দিন খান তাঁরা। সামর্থ্য না থাকায় সন্তানের লেখাপড়া করানো তাঁর জন্য বিলাসিতা। সংসারের প্রয়োজনে কালিন্দী নদীতে মাছ ধরে জ্যোৎস্না আলাদাভাবে তার পড়ালেখার খরচ জুগিয়েছে। উপজেলা সদরের একটি সরকারি কলেজে মেয়েকে ভর্তির প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি।

পারণপুর আব্দুর রউফ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবেন্দ্র মণ্ডল জানান, জ্যোৎস্না মেধাবী। সে নিজের চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে। সহযোগিতা পেলে সে তার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।

মায়ের সহায়তায় এতটুকু এসেছে আয়শা

মায়ের কাছে বড় হয়েছে আয়শা হক। মা সংসার চালানোর পাশাপাশি পড়াশোনার খরচ জোগাড় করেছেন। আত্মীয়স্বজনেরাও সাহায্য করেছেন। তাঁদের সহযোগিতা বিফলে যায়নি। বাখুন্ডা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আয়শাই একমাত্র শিক্ষার্থী, যে চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। আয়শা ফরিদপুরের সরকারি সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। তার ইচ্ছা চিকিৎসক হওয়ার।

আয়শাদের বাড়ি ফরিদপুর সদরের গেরদা ইউনিয়নের বাখুন্ডা পূর্বপাড় গ্রামে। ছয় বছর আগে বাবা আজিজুল হক আরেকটি বিয়ে করেছেন। তিনি বর্তমানে প্রবাসে আছেন। কোনো খরচ দেন না পরিবারকে। দুই বোনকে নিয়ে মা শিখা হক সংসার সামলাচ্ছেন।

শিখা হক বলেন, ‘মেয়ের আশা তো অনেক উঁচুতে। কিন্তু অভাবের সংসার। বড় ক্লাসে লেখাপড়ার অনেক খরচ। ওর স্বপ্ন পূরণ করার অবস্থা আমার নেই।’

বাখুন্ডা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সৈয়দ ওমর ফারুক বলেন, আয়শার পক্ষে এইচএসসি পাস করে মেডিকেলে ভর্তি হওয়া কঠিন ব্যাপার হবে না। কিন্তু এ পর্যন্ত তো ওকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তরমিনের

তরমিন আক্তারের বাবা মো. আলামিন পেশায় রিকশাচালক ও মা সুলেনা খাতুন গৃহিণী। তাঁদের বাড়ি সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের বৌলাম গ্রামে। বছরের বেশির ভাগ সময় তাঁরা ঢাকায় থাকেন। তরমিনের ঠাঁই হয়েছে মামাবাড়িতে। মামারও টানাপোড়েনের সংসার। লেখাপড়া করার উপযুক্ত পরিবেশ, নতুন জামা ও ভালো খাবারদাবার না পেলেও সে পড়াশোনার সঙ্গে আপস করেনি।

তরমিন বলে, অভাব ও অসুস্থতার কারণে ১০ বছর আগে জায়গাসহ বসতঘর বিক্রি করে দেন তরমিনের বাবা। অভাবের কারণে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার লেখাপড়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় পরিবার। কিন্তু তার কান্না ও লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ দেখে তরমিনের মা-বাবা মত পাল্টান। এবার বাদশাগঞ্জ সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেয় সে। লেখাপড়া করে সে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা হতে চায়।

বাবা মো. আলামিন বলেন, ‘রিকশা চালিয়ে যা রোজগার হয়, তাতে কুনুরকমে সংসার চলে। হুনছি মেয়ে ভালা রিজাল্ট করছে। হে বড় অফিসার অইতে চায়। অহন হেরে কলেজে পরাইবার খরচ কই পাইবাম হেই চিন্তায় রাইতে ভালা কইরা আমরা ঘুমাইতাম হারি না।’

প্রাইভেট পড়িয়েছে মীম

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরী গ্রামের বাবু শেখ ও মজিদা খাতুন দম্পতির মেয়ে মীম আক্তার। ঠুটিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এবার সে পরীক্ষা দিয়েছে। দিনমজুর বাবার ওপর ছয় সদস্যের পরিবার চালানোর চাপ। তার উপার্জনের টাকায় সংসার চলে না। খেয়ে না খেয়েই দিন কেটেছে তাদের। অভাবের তাড়নায় একপর্যায়ে মীমের পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়। এরপর সে সময় মায়ের সঙ্গে প্রতিবেশীদের জামাকাপড় তৈরির কাজ আর প্রাথমিকের শিশুদের প্রাইভেট পড়িয়ে সে নিজের লেখাপাড়ার খরচ জোগানোর ব্যবস্থা করে।

মীম বলে, আর্থিক সংগতি না থাকার পরও বাবা-মায়ের উৎসাহ ও নিজের চেষ্টায় এ পর্যন্ত পৌঁছেছে। মা–বাবার স্বপ্ন ভবিষ্যতে তাঁদের মেয়ে চিকিৎসক হবে। সেই ইচ্ছা পূরণের জন্য সে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাবে।

ঠুটিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মীর আইয়ুব আলী বলেন, সচ্ছল ব্যক্তি বা কোনো প্রতিষ্ঠানের সামান্য সহযোগিতা পেলে মীম তার পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে।

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কল্যাণ ব্যানার্জি, সাতক্ষীরা; প্রবীর কান্তি বালা, ফরিদপুর; আরিফুল গণি, সিরাজগঞ্জ ও সালেহ আহমদ, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জ]