আগুনে পুড়ল এসএসসি পরীক্ষার্থী মায়ের স্বপ্ন

অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া দোকানপাট ও বসতবাড়ি। বৃহস্পতিবার পটুয়াখালী শহরের পুরানবাজার এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

এসএসসি পরীক্ষার্থী তিথি নাগ। ছোটবেলা থেকেই অভাব-অনটনের সঙ্গে তাঁর বেড়ে ওঠা। দারিদ্র্যের কারণে অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় নিজের ঘরে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। হঠাৎ ‘আগুন আগুন’ চিৎকার শুনে আঁতকে ওঠেন। এরই মধ্যে বিকট শব্দে একটি তেলের ড্রাম বিস্ফোরিত হয়। তেল ছড়িয়ে পড়ে তিথিদের ঘরে। কিছু ভাবার আগেই ৯ মাসের শিশুসন্তানকে বুকে নিয়ে আগুন থেকে বাঁচেন তিথি (১৯)। তবে আগুনে তাঁদের ঘরটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। সেই সঙ্গে পুড়ে ছাই হয়েছে তিথির সব বইপত্রও।

গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার দিকে পটুয়াখালী শহরের পুরানবাজার এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত অর্ধশত দোকান ও বাসাবাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিট আড়াই ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে নিঃস্ব হয়েছেন তিথিদের মতো অনেকেই।

সরেজমিনে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তিথি নাগ জানান, তাঁর জন্মের পরপরই মা অনিতা রানীকে ফেলে অন্যত্র চলে যান তাঁর বাবা। দুই ভাইও বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। মা তাঁকে নিয়ে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পটুয়াখালীর পুরানবাজার এলাকার একটি ক্লিনিকে আয়ার কাজ নেন।

তিথি আরও বলেন, অভিভাবক না থাকা ও অভাবের কারণে তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। অল্প বয়সে তিনি মা হন। স্বামী অন্যের দোকানে অল্প বেতনে কাজ করেন। অভাব-অনটনে বড় হওয়া তিথি পড়ালেখা করে নিজে কিছু করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু আগুনে তাঁর সেই স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল। তিনি পটুয়াখালী সদর উপজেলার লাউকাঠী শহীদ স্মৃতি বিদ্যানিকেতন থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।

অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকায় নাম লেখাতে মায়ের সঙ্গে টাউন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এসেছেন তিথি নাগ। বৃহস্পতিবার সকালে
ছবি: প্রথম আলো

তিথি ও তাঁর মা অনিতা রানী স্থানীয় টাউন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ক্ষতিগ্রস্তের তালিকায় নাম লেখাতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিথি বলেন, ‘আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এক পোশাকে বাচ্চাকে নিয়ে মার হাত ধরে ঘর থেকে বের হয়ে আসা। রোববার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের পরীক্ষা। কীভাবে পরীক্ষা দেব? সবকিছু শেষ হয়ে গেল।’

এ সময় কথা হয় আরেক শিক্ষার্থী বৈশাখী কর্মকারের সঙ্গে। তিনি পটুয়াখালী নার্সিং ইনস্টিটিউটের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। বইপত্র, জামাকাপড় কোনো কিছুই আগুন থেকে রক্ষা করতে পারেননি। বইপত্র কিনতে না পারলে তাঁর লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যেতে পারে বলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

পাশেই আরেক নারীকে কাঁদতে দেখা গেছে। তাঁর ছেলে মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। কিন্তু কোনোভাবেই মায়ের কান্না থামাতে পারছিল না সে। আগুনে নিঃস্ব হয়েছেন তাঁরা। এখন খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় খুঁজছেন। এদিকে আগুনে নিঃস্ব পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়িয়েছেন পটুয়াখালী পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাহিদ হোসেন। আজ বৃহস্পতিবার সকালে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের রান্না করা খাবার খাওয়ান।

অগ্নিকাণ্ডে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান-বাড়িঘর পুড়ে যাওয়ার পাশাপাশি পাশের পাকা ভবনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট যাদব সরকারের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। আজ সকাল থেকে কমিটির সদস্যরা স্থানীয় টাউন উচ্চবিদ্যালয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকাসহ বক্তব্য শোনেন।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এক শিশু। বৃহস্পতিবার সকালে পটুয়াখালীর টাউন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে
ছবি: প্রথম আলো

কমিটির সদস্য জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন দেবনাথ বলেন, সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ১৪টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ২৮টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তালিকা পেয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। প্রাথমিকভাবে পাঁচ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির ধারণা করছেন। তবে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ নিরূপণে আরও সময় লাগবে।

পটুয়াখালী ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আমিনুল ইসলাম সরকার বলেন, এখনো অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা যায়নি। জেলা প্রশাসন থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির তদন্ত শেষে অগ্নিকাণ্ডের কারণ ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।জেলা প্রশাসক মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা তৈরির পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হবে।’