টাঙ্গাইলের রাজনীতির ‘ধূম্রজাল ধ্বংস’ করতে খান ও সিদ্দিকী পরিবারে ‘নতুন বন্ধন’

শামসুর রহমান খান স্মৃতি ফাউন্ডেশনের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানে আমানুর রহমান খান ও আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। গতকাল টাঙ্গাইলের ঘাটাইলেছবি: সংগৃহীত

প্রায় পাঁচ দশকের বিভেদ ভুলে ‘এক’ হয়েছে টাঙ্গাইলের আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে আলোচিত সিদ্দিকী পরিবার ও খান পরিবার। এক মঞ্চ থেকে দুই পরিবারের দুজন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য টাঙ্গাইলের রাজনীতির ‘ধূম্রজাল ধ্বংস’ করতে নতুন ‘বন্ধনে আবদ্ধ’ হওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছেন।

গতকাল শনিবার টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে ‘শামসুর রহমান খান শাহজাহান স্মৃতি ফাউন্ডেশনের’ শিক্ষাবৃত্তি প্রদান অনুষ্ঠানের মঞ্চ থেকে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান ও টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী। শামসুর রহমান সংসদ সদস্য আমানুরের চাচা।

আলোচিত দুই পরিবারের এমন অবস্থান নিয়ে টাঙ্গাইলের রাজনীতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা। অনেকেই এটিকে আওয়ামী রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হিসেবে দেখছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এই দুই পরিবারের বিরোধ প্রায় পাঁচ দশক ধরে। দুই পরিবারই এখন দলীয় রাজনীতিতে বেকায়দায়। লতিফ সিদ্দিকীর মাথার ওপর রয়েছে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারাদেশ। খান পরিবারের সন্তানেরা আওয়ামী লীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। তাঁরা হারিয়েছেন দলীয় পদ-পদবি। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লতিফ সিদ্দিকী ও খান পরিবারের আমানুর রহমান খান ওরফে রানা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

শনিবারের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আবদুল লতিফ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমার সাথে কারও সম্প্রীতি নাই, সখ্য নাই। শাহজাহান ভাইয়ের (শামসুর রহমান খানের ডাক নাম) সাথেও আমার দ্বন্দ্ব ছিল, কিন্তু সংঘাত বা সংঘর্ষ হয়নি। দ্বন্দ্বটা প্রকাশ হয়েছে যুক্তিতে, চিন্তাভাবনার বিনিময়ে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল কী হয়েছে, সেটা বেদনাদায়ক, আনন্দদায়ক, দুঃখজনক না আশাপ্রদ—এ নিয়ে আমার ভাবনা নাই। আজকে কী হবে, সেটাই আমার ভাবনা।’

শামসুর রহমান খানের নামে বৃত্তি প্রদানের সঙ্গে ভবিষ্যতেও থাকার কথা উল্লেখ করে লতিফ সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘সত্যিই যদি আতোয়ার ভাইয়ের ছেলেদের, শাহজাহান ভাইয়ের ভাতিজাদের (সংসদ সদস্য আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা) মন আলোকিত হয়ে থাকে, আলহামদুলিল্লাহ। আমি বন্ধনে আবদ্ধ হতে রাজি আছি।’

এর আগে বক্তৃতাকালে সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান লতিফ সিদ্দিকীর উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি আমাদের অভিভাবক। আজকে টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে যে ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আপনাকে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। আমি এবং আমার পরিবার আপনার সঙ্গে থেকে সেই ধূম্রজাল ধ্বংস করব। এদেশ স্বাধীন করার জন্য আপনি যে ত্যাগ করেছেন, আমার চাচা শামসুর রহমান খান অনেক ত্যাগ করেছেন, অনেক কষ্ট করেছেন। যারা কোনো কষ্ট করেনি, তারা রাজনীতি ও আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। আপনি অভিভাবক হিসেবে যে নির্দেশ দেবেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব।’

আরও পড়ুন

শামসুর রহমান খান শাহজাহান স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সাবেক সংসদ সদস্য আতাউর রহমান খান, ঘাটাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইরতিজা হাসান, ঘাটাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু সালাম মিয়া প্রমুখ বক্তব্য দেন।

আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭৫ সালে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর টাঙ্গাইল জেলা গর্ভনর মনোনীত হন সিদ্দিকী পরিবারের সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম। সে সময় গর্ভনর পদপ্রত্যাশী ছিলেন তৎকালীন সংসদ সদস্য শামসুর রহমান খান ওরফে শাহজাহান। তখন থেকেই শুরু হয় খান পরিবার ও সিদ্দিকী পরিবারের দ্বন্দ্ব। নব্বইয়ের দশকে সিদ্দিকী পরিবারের সন্তান মুরাদ সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকীর (লতিফ সিদ্দিকীর ছোট ভাই) নেতৃত্বে ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে একটি বলয় তৈরি হয়। অপর দিকে খান পরিবারের সন্তান (শামসুর রহমান খানের ভাতিজা) আমিনুর রহমান খান ওরফে বাপ্পি, আমানুর রহমান খান, সহিদুর রহমান খান ওরফে মুক্তির নেতৃত্বে পাল্টা বলয় গড়ে ওঠে। এই দুই পক্ষের মধ্যে অনেক সংঘর্ষ, মামলা-হামলার ঘটনা হয়। দুই পক্ষের বেশ কয়েকজন খুন হন।

আমিনুর রহমান ২০০৩ সালে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। সেই মামলায় আসামি করা হয় মুরাদ সিদ্দিকী ও আজাদ সিদ্দিকীকে। এ নিয়ে উভয় পরিবারের তিক্ততা আরও অনেক বেড়ে যায়। ১৯৯৯ সালে কাদের সিদ্দিকী দল থেকে বের হয়ে যান। তখন আওয়ামী রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় খান পরিবারের কাছে। ২০১৪ সালে লতিফ সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন। একই বছর আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত হয়ে সংসদ সদস্য আমানুর ও তাঁর ভাইয়েরা আত্মগোপনে চলে যান। তাঁরা দলীয় পদ–পদবিও হারান। এর মধ্য দিয়ে সিদ্দিকী ও খান উভয় পরিবার আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব থেকে ছিটকে পড়ে।

আরও পড়ুন

বিবদমান দুই পরিবারের এক হওয়া নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। লতিফ সিদ্দিকীর নির্বাচনী এলাকা কালিহাতী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোজাহারুল ইসলাম তালুকদার বলেন, লতিফ সিদ্দিকী এখন দলীয় নীতি-আদর্শের মধ্যে নেই। তিনি ব্যক্তিগত আদর্শ নিয়ে আছেন। নির্বাচনের আগে থেকেই ভেতরে–ভেতরে খান পরিবারের সঙ্গে তাঁর একটা সমঝোতা ছিল। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য তিনি এই সমঝোতা করেছিলেন।

ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যা মামলার আসামি। লতিফ সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক। তাঁর মতো একজন লোকের কাছে এমনটা আশা করেননি।

ঘাটাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা ও আনেহলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তালুকদার মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, এর মধ্য দিয়ে আগামী দিনে টাঙ্গাইলের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হবে। আওয়ামী লীগ নামধারী হাইব্রিড ও লুটেরা নেতাদের পতন হবে। তৃণমূলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের নিয়ে শক্তিশালী আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হবে।

আরও পড়ুন