একের পর এক প্রতিরোধ ও যুদ্ধে বিজয় আসে

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুটা হয়েছিল মার্চে। এরপর ছোট-বড় অসংখ্য যুদ্ধে রক্তাক্ত পথ পেরিয়ে ডিসেম্বরে আসে বিজয়। প্রতিরোধের সেই লড়াই নিয়ে এ আয়োজন।

একাত্তরে কুমিল্লায় যে কটি বড় যুদ্ধ হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ‘কটকবাজার যুদ্ধ’। এই যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের স্মরণে কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলায় নির্মিত ‘কটকবাজার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ’ছবি : প্রথম আলো

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে কুমিল্লা ছিল গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্র। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক, কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট, বিমানবন্দর ও ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ার কারণে এখানে একের পর এক বড় যুদ্ধ ও প্রতিরোধ হয়েছে।

১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেবীদ্বারে বড় একটি যুদ্ধ হয়। এটি ‘ভিংলাবাড়ি-জাফরগঞ্জ শ্রীপুকুরপাড় জামে মসজিদ যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত। প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছিল এর রণক্ষেত্র। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (চতুর্থ খণ্ড) বইয়ে এই যুদ্ধ নিয়ে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধে ১৪ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিকামী পাঁচজন শহীদ হন।

দেবীদ্বার উপজেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সামাস এই যুদ্ধে গুলিবিদ্ধ হন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার বাঁ হাতের একটি আঙুলে গুলি লাগে। এই যুদ্ধের পর রাজাকারদের কারণে আমাদের এলাকায় থাকা কষ্টকর হয়ে পড়ে। পরে আমরা ভারতে চলে যাই। সেখান থেকে আমাকে পাঠানো হয় রংপুর ৯ নম্বর সেক্টরে।’

জেলার চান্দিনা উপজেলার একটি বড় যুদ্ধ ছিল ‘বরকামতা জনযুদ্ধ’। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ (ষষ্ঠ খণ্ড) বইয়ে বলা হয়েছে, ১৪ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা বরকামতা গ্রামে হানা দেবে—এমন খবর পেয়ে সিপিবি নেতা আবদুল হাফেজ ও পুলিশ সদস্য আবদুল হালিমের নেতৃত্বে স্থানীয় প্রায় পাঁচ হাজার মুক্তিকামী একত্র হন। ওই দিন বিকেলে এক প্লাটুন পাকিস্তানি সেনা বরকামতা কাঠেরপুল এলাকায় নেমে হেঁটে বরকামতার দিকে এগোতে থাকলে আগে থেকে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। জনতার পক্ষে দুটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল ছিল। তা থেকে গুলি ছুড়লে পাঁচজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। বাকিরা ভয়ে পিছু হটে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। ওই রাতে পুনরায় বরকামতা গ্রামে এসে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় পাকিস্তানি বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টর দুই) বইয়ে বলা হয়েছে, বড়কামতা গ্রামে এপ্রিল মাসের দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর তৎপরতা বেড়ে যায়। তখন সুবেদার গোলাম আম্বিয়ার নেতৃত্বে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা বড়কামতা এলাকায় জড়ো হন। ২৫ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধারা চান্দিনার পূর্ব দিকে ঢাকা-কুমিল্লা সড়কের একটি সেতু উড়িয়ে দেন। পরের দিন সকালে চারটি গাড়ি নিয়ে ৫০–৬০ জন পাকিস্তানি সেনা বড়কামতায় এসে আক্রমণ করে এবং এলাকার বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়।

কুমিল্লার বড় যুদ্ধের মধ্যে আছে আদর্শ সদর উপজেলার কটকবাজারের যুদ্ধ। লেখক আবুল কাসেমের মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা বইয়ের চতুর্থ খণ্ডে এই যুদ্ধ নিয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে অবস্থিত হওয়ায় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে কটকবাজারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কটকবাজার থেকে মুক্তিবাহিনীর ছোট ছোট দল কুমিল্লা শহরে এসে আক্রমণ চালিয়ে আবার চলে যেত। ৯ মে এখানে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানিদের প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। শত্রুপক্ষের ১০০ থেকে ১৫০ জন এ যুদ্ধে নিহত হয়।

ওই যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেওয়া সফিউল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ওই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার জুম্মা খান, ল্যান্স নায়েক আবদুল কাদের মোল্লা ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র ইমতিয়াজউদ্দিনসহ সাতজন শহীদ হন।

১১ নভেম্বর জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বেতিয়ারা গ্রামে ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর যুদ্ধে নয়জন গেরিলা নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান (দ্বিতীয় খণ্ড) বইয়ে বলা হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধারা ওই রাতে শত্রুর অবস্থানে ঢোকার পরিকল্পনা করেন। সে হিসেবে আটজন মুক্তিযোদ্ধাকে দুই ভাগে ভাগ করে বেতিয়ারা চৌধুরীবাড়ির দুই পাশে রাখা হয়। স্থানীয় দুই মুক্তিযোদ্ধাকে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক শত্রুমুক্ত কিনা পরীক্ষা করে দেখার জন্য পাঠানো হয়। রাত ১২টার দিকে তাঁরা মূল দলকে এগিয়ে যাওয়ার সংকেত দেন। মুক্তিযোদ্ধা দলটি বেতিয়ারা গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে যেতে থাকলে পাকিস্তানি সেনারা তিন দিক থেকে তাদের ওপর গুলি ছোড়ে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। ঘটনাস্থলে নয়জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। সেদিনের কথা স্মরণ করে প্রতিবছরের ১১ নভেম্বর পালিত হয় ‘বেতিয়ারা দিবস’।

৭ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী কুমিল্লা বিমানবন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর ২২ বেলুচ রেজিমেন্টের প্রধান ঘাঁটিতে আক্রমণ শুরু করে। রাতভর যুদ্ধ হয়। পরের দিন ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লায় ওড়ে মুক্তির পতাকা। এদিনের কথা স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সফিউল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গাড়িতে করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে সকাল আটটার দিকে কুমিল্লা শহরের চকবাজার পৌঁছান তাঁরা। সে এক অভাবনীয় অকল্পনীয় দৃশ্য, যার অনুভূতি সহজে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না কখনো।

এমন অসংখ্য সুখ-দুঃখের স্মৃতি দিয়ে লেখা বাংলাদেশের বিজয়ের গল্প।