রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মিলনায়তনে ১৬ কোটি টাকার সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন

১৬ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয়ে করা সংস্কারকাজের মান নিয়ে প্রশ্ন। তথ্য অধিকার আইনেও পাওয়া যায়নি তথ্য।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনের পুরোনো ভবনে বসানো হয়েছে কেন্দ্রীয় শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

১৬ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তন সংস্কার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সংস্কৃতিকর্মীরা। সংস্কারের পর মিলনায়তন ভাড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকার বেশি করার পরিকল্পনায় হতাশ ক্যাম্পাসের সংগঠনগুলো।

মিলনায়তনের সংস্কারকাজের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তথ্য চেয়ে এই প্রতিবেদক তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করেন। দুই দফা আবেদন করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তর প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য দেয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ভৌত অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মিলনায়তনের সংস্কারকাজে ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দুই ভাগে কাজটির মেরামত ও সংস্কারের (ইলেকট্রো মেকানিক্যাল) কাজ পায় ঢাকা প্রিমিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি ২০ লাখ ৪ হাজার ৫৮৯ টাকা।

যার মাধ্যমে মিলনায়তনে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র স্থাপন, অত্যাধুনিক সাউন্ডসিস্টেম ও লাইটিংয়ের কাজ করা হয়। মেরামত ও সংস্কারের (ভৌত) অংশের জন্য ব্যয় ধরা হয় ৬ কোটি ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪১১ টাকা। যার মধ্যে রয়েছে কাচের জানালা, টাইলস, চেয়ার, মঞ্চ ও সোফাসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের ব্যবস্থা করা। এই কাজ করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হোসেন এন্টারপ্রাইজ।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, মিলনায়তন সংস্কারের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের দ্বিতীয় মোয়দে। কার্যাদেশ দেওয়া হয় ২০২১ সালের ১১ মার্চ। বছরখানেক আগে বর্তমান উপাচার্যের সময়ে কাজ শেষ হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক দল গত বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি মিলনায়তনের ব্যাপারে ছাড়পত্র দেয়। এরপর মে মাসে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কমিটি ইতিবাচক মতামত দেওয়ার পর সম্প্রতি মিলনায়তন বুঝে নিয়েছে প্রশাসন।

মিলনায়তনের সংস্কারকাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও নাট্যব্যক্তিত্ব মলয় ভৌমিক বলেন, সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ চেয়ার মেরামত করলেই মিলনায়তনটি চলত। তা না করে প্রায় ১৬ কোটি টাকা ব্যয় করে সংস্কারের নামে এটি নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। আগের ‘অ্যাকুইস্টিক সিস্টেম’ চমৎকার ছিল। কেউ সেটি সংস্কার করতে বলেনি। কিন্তু সংস্কার করেই আগের চেয়ে খারাপ করে ফেলা হয়েছে। ১৯৬৭ সালে নির্মিত ভবনের ছাদের ওপরে সেন্ট্রাল এসি বসানো হয়েছে। এতে পুরো ভবনটি এখন ঝুঁকিপূর্ণ।

উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মিলনায়তনের সংস্কারকাজে ব্যয় হয়েছে ১৬ কোটি ২৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। দুই ভাগে কাজটির মেরামত ও সংস্কারের (ইলেকট্রো মেকানিক্যাল) কাজ পায় ঢাকা প্রিমিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এই খাতে বরাদ্দ ছিল ১০ কোটি ২০ লাখ ৪ হাজার ৫৮৯ টাকা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনগুলোর জন্য মিলনায়তনের ভাড়া বাড়ানো নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে মলয় ভৌমিক বলেন, আগে দেড় হাজার টাকা ভাড়া ছিল। এখন টিকিট বিক্রি করে মিলনায়তনের ভাড়া তোলার মতো কোনো সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।

মিলনায়তনের ভাড়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, মিলনায়তন চালুর পর যতগুলো সংগঠন অনুষ্ঠান করেছে তাদের ১ লাখ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। মিলনায়তন ব্যবহার নীতিমালা করতে একটি কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি এখন পর্যন্ত একটি সভা করেছেন। যেখানে ভাড়া ১ লাখ টাকা বেশি রাখার বিষয়ে সদস্যরা মতামত দিয়েছেন।

ক্যাম্পাসের সাংস্কৃতিক সংগঠন সমকাল নাট্যচক্র গত বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত ১৬ বার পথনাটক ও ৮ বার মঞ্চনাটক করেছে। ভাড়া বাড়ানোর কারণে মিলনায়তনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না উল্লেখ করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সানজিদ সালভি বলেন, ‘যে পরিমাণ ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি আমাদের সাধ্যের বাইরে।’

পিপিআর একটি উপধারার কারণে সব তথ্য দেওয়া যাবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি পরিষ্কার নন। এ জন্য তিনি সম্পূর্ণ তথ্য দিতে পারছেন না। এখানে দুর্নীতির কোনো ব্যাপার নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক খন্দকার শাহরিয়ার রহমান

সংস্কারের পর যাঁরা মিলনায়তনে অনুষ্ঠান দেখেছেন, তাঁরা বলছেন, চেয়ারের রং হাতের সঙ্গে এখনই উঠে যাচ্ছে। খুবই নিম্নমানের কাজ হয়েছে। এই সংস্কারকাজ নিয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এ ব্যাপারে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তথ্য অধিকার আইনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে তথ্য চেয়ে আবেদন করা হয়। তখন তথ্য না দিয়ে বলা হয়, মিলনায়তন হস্তান্তরিত হয়নি। ফাইল ঠিকাদারের কাছে রয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি একইভাবে তথ্য চাওয়া হলে ‘ফাইল অডিট টিমের কাছে আছে’ উল্লেখ করে আগের মতোই কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি।

সম্পূর্ণ তথ্যের জন্য একই আবেদনের বরাত দিয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি আবারও যোগাযোগ করা হলে ২৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়। ওই দিনও সম্পূর্ণ তথ্য দেওয়া হয়নি। যুক্তি হিসেবে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) ২০০৮–এর একটি পাতার (বিধি ৪৪) ফটোকপি সঙ্গে দেওয়া হয়। যে পাতায় মার্কার কলম দিয়ে চিহ্নিত একটি লাইন হচ্ছে, ‘এই উপবিধিতে যাহাই থাকুক না কেন, কোনো উপযুক্ত আদালতের আদেশ ব্যতীত উক্ত ক্রয়কারী নিম্ন বর্ণিত ক্ষেত্রে তথ্য প্রকাশ করিবে না।’ এর ছয়টি ক্ষেত্র রয়েছে। যার দুটি চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। যেগুলো ক্রয় কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী পক্ষগুলোর ব্যবসায়িক স্বার্থ ক্ষুণ্ণ সংশ্লিষ্ট।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের পরিচালক খন্দকার শাহরিয়ার রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পিপিআর একটি উপধারার কারণে সব তথ্য দেওয়া যাবে কি না, সে ব্যাপারে তিনি পরিষ্কার নন। এ জন্য তিনি সম্পূর্ণ তথ্য দিতে পারছেন না। এখানে দুর্নীতির কোনো ব্যাপার নেই।

চলমান কোনো কাজই তাঁর সময়ে শুরু হয়নি। মিলনায়তনের এসি এক ঘণ্টা চালু রাখতে ছয় হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল ওঠে। মিলনায়তনের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার

অবশ্য সাবেক সচিব ও সিপিটিইউ–এর (সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিট) সাবেক মহাপরিচালক ফারুক হোসেন মনে করেন, চুক্তিটি ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন হয়েছে। মিলনায়তনটি চালুও হয়েছে। সেক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন ও পিপিআর অনুযায়ী জনস্বার্থে তথ্য দিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, চলমান কোনো কাজই তাঁর সময়ে শুরু হয়নি। মিলনায়তনের এসি এক ঘণ্টা চালু রাখতে ছয় হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল ওঠে। মিলনায়তনের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চারতলা শেখ রাসেল স্কুল নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি টাকা। সেখানে মিলনায়তন সংস্কারে ১৬ কোটি টাকা ব্যয় অবিশ্বাস্য। এই টাকায় নতুন মিলনায়তন বানানো যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি আবদুল মজিদ বলেন, মিলনায়তন আধুনিকায়নের নামে ভাড়া বাড়িয়েছে প্রশাসন। এতে শুধু সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডই ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়েই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।