জেলেরা ছাড়া পেলেন ‘মুক্তিপণ’ দিয়ে, উদ্ধারের দাবি পুলিশের

মোংলা থানা–পুলিশের উদ্ধার দেখানো ৮ জেলে। তাঁরা মুক্তিপণ দিয়ে আজ সকালে নিজেরাই চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয়ে আসেন বলে বন বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন
ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিপণের দাবিতে সুন্দরবন থেকে অপহৃত ১১ জেলেকে উদ্ধারের দাবি করে সংবাদ সম্মেলন করেছিল বাগেরহাট জেলা পুলিশ। তবে জেলেদের স্বজনদের ভাষ্য, দস্যুদের মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেয়েছেন অপহৃত ১৫ জেলে। তাঁদের মধ্যে মুক্তিপণ দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার রাতে শরণখোলায় ফেরেন চার জেলে। বাকি ১১ জেলেকে উদ্ধারের দাবি করেছে পুলিশ।

সুন্দরবনে বিশেষ অভিযানের কথা জানিয়ে আজ বুধবার দুপুরে শরণখোলা থানায় সংবাদ সম্মেলন করেন পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক। তিনি বলেন, শরণখোলা, মোংলা, রামপাল ও মোরেলগঞ্জ থানা-পুলিশের অভিযানে ভোরে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ এলাকা থেকে ১১ জেলেকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তিনজনকে শরণখোলা থানা-পুলিশ ও আটজনকে মোংলা থানা-পুলিশ উদ্ধার করে।

আরও পড়ুন

পুলিশের উদ্ধার দাবি করা জেলেরা হলেন—হানিফ হাওলাদার (৪৮), সোহেল মল্লিক (২৮), আসাদুল শেখ (৩২), মো. আকরাম হোসেন (৪২), আনিচ শেখ (২২), মো. মিলন শেখ (২৩), মো. রফিকুল ইসলাম খান (৩৫), শুকুর আলী ব্যাপারী (৩০), মো. মনির ব্যাপারী (৩৬), মো. অলি শিকদার (৪৮) ও মো. বকতিয়ার ব্যাপারী (৩৫)। তাঁদের সবার বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল, মোংলা, মোরেলগঞ্জ, সদর ও খুলনার বটিয়াঘাটা উপজেলায়।

অন্যদিকে মুক্তিপণ দিয়ে শরণখোলায় ফেরা চার জেলে হলেন—সালাম হাওলাদার (৬৫), ইমাম খান (২৫), ছলেমান হাওলাদার (৩০) ও ইউসুফ হাওলাদার (৩৫)। তাঁরা প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়েছেন বলে জানান।

মোংলায় পুলিশের উদ্ধার দেখানো আট জেলের মধ্যে চারজন ও তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয় থেকে অনুমতি নিয়ে ১৩ ডিসেম্বর তাঁরা সুন্দরবনে মাছ ধরতে যান। বনের বিভিন্ন খালে কাঁকড়া ও মাছ শিকার করার সময় একদল বনদস্যু তাঁদের ওপর হামলা চালায় এবং প্রতি নৌকা থেকে একজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে বনদস্যুদের মুক্তিপণ দেওয়ার পর তাঁরা ছাড়া পান।

মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া জেলেদের স্বজন নাসির শেখ, সোহরাব শেখ, ফারুক খান ও শেখ মো. মারুফ বিল্লাহ বলেন, সাত দিন জিম্মি থাকার পর গতকাল রাতে মুক্তিপণের এক লাখ ৮০ হাজার টাকা পেয়ে ওই জেলেদের বন বিভাগের হরিণটানা টহল ফাঁড়িতে পৌঁছে দেয় দস্যুরা। জেলেরা গতকাল রাতে ছাড়া পেয়ে হরিণটানা টহল ফাঁড়ির ট্রলারে করে আজ সকালে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয়ে আসেন। এরপর মোংলা থানা-পুলিশ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য দুপুর ১২টার দিকে থানায় নিয়ে যায়।

বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো. শহিদুল ইসলাম হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজ সকাল সাড়ে সাতটায় ওই জেলেরা নিজেরাই আমাদের চাঁদপাই রেঞ্জ কার্যালয়ে আসেন।‌ সেখানে আমরা তাঁদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলাম। সেই সময় খবর পেয়ে পুলিশ এসে আমাদের অফিস থেকে তাঁদের নিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ওই জেলেরা সবাই বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ছোট ডিঙি নৌকায় মাছ ও কাঁকড়া শিকার করতে সুন্দরবনে গিয়েছিলেন। ওই নৌকায় সাধারণত দু–তিনজন জেলে থাকেন। অপহরণকারীরা সাতজন ছিল বলে জেলেরা তাঁদের জানিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার দাবি করেছিলেন, ‘৫–৬ দিন পর অপহৃত ১১ জেলেকে আমরা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। এ বিষয়ে আমরা তৎপর আছি।’ তিনি বলেন, উদ্ধার জেলেরা পুলিশের হেফাজতে এবং সবাই সুস্থ আছেন। তবে জেলেদের অপহরণ বা উদ্ধারের স্থান সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু বলেননি। এ ছাড়া অপহরণকারীদের বিষয়ে ‘তদন্তের স্বার্থে’ কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

ফিরে আসা জেলেরা বলছেন, অপহরণকারী দস্যুরা সদ্য আবির্ভূত ‘নয়ন বাহিনী’র সদস্য। নয়ন বাহিনীতে সাত-আটজন সদস্য আছে। তাঁদের কাছে দুটি পাইপগান, বেশ কিছু রামদাসহ দেশি অস্ত্র আছে। মুক্তিপণের জন্য দস্যুদের আস্তানায় এখনো একটি ফিশিং ট্রলার ও কয়েকজন জেলে জিম্মি দেখেছেন তাঁরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে দস্যুদের থেকে ছাড়া পাওয়া এক জেলে বলেন, ‘আমাদের নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁদের কাছে দুটি পাইপগান, ছয়টি রামদা ও বেশ কিছু লাঠি ছিল। দুটি ডিঙি নৌকায় আটজন দস্যু ছিল। তাদের কাছে এখনো কয়েকজন জেলে আটকা আছেন।’

জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৩ থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে বনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ১৮–২০ জন জেলেকে অপহরণ করে দস্যুরা। এর মধ্যে ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা ও ধানসাগর স্টেশনের বেড়ির খাল ও হরমল খালে কাঁকড়া শিকারের সময় জেলে বহরে হামলা চালিয়ে ১১ জনকে অপহরণ করা হয়। মুক্তিপণ হিসেবে তাঁদের পরিবার ও মহাজনদের কাছে ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবি করা হয়। অপহরণকারী দস্যুরা নয়ন বাহিনীর সদস্য বলে জেলেরা জানান।

মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়া শরণখোলায় চার জেলে প্রথম আলোকে বলেন, মুক্তিপণের টাকার জন্য দস্যুরা তাঁদের মারধর করত। কোনো দিন এক বেলা আবার কোনো দিন খেতেও দিত না। মুক্তিপণ দেওয়ার পর গতকাল রাতে সুন্দরবনের হরিণটানা এলাকার একটি খালে দস্যুরা তাঁদের ছেড়ে দেয়। সেখান থেকে তাঁরা নৌকা বেয়ে ভোরে লোকালয়ে আসেন।

পুলিশ সুপার কে এম আরিফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা প্রথম থেকে জেলেদের সুস্থ ও নিরাপদে উদ্ধারের বিষয়ে কাজ করেছি। তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পুলিশি কৌশল অবলম্বন করে উদ্ধার করা হয়েছে। জেলেরা আমাদের হেফাজতে আছেন। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তাঁদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।’

মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের জানা নেই। এখন তাঁরা যদি কোথাও যোগাযোগ করে থাকেন, সেটা ভিন্ন।’