এরশাদকে ঘিরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল পুরো পরিবার, অকালমৃত্যুতে আবার অনিশ্চয়তা
অভাবের সংসারে সংগ্রাম করেই বড় হয়েছিলেন এরশাদ হোসেন (২৫)। রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি করেছেন পড়াশোনা। প্রায় সাত বছর আগে যোগ দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীতে। এরপর বিয়ে করে হয়েছেন একটি ছেলেসন্তানের বাবা। বৃদ্ধ মা–বাবা তাঁর ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এরই মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় নিভে গেল এরশাদের জীবনপ্রদীপ। তাঁর মাত্র ১৫ মাস বয়সী ছেলেটিকে নিয়ে এখন দিশাহারা পুরো পরিবার।
এরশাদ হোসেন পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত কাজলদীঘি ইউনিয়নের বোয়ালমারী-টুনিরহাট এলাকার আবদুল খালেকের ছেলে। তিনি সাভার সেনানিবাসে সৈনিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
গত শুক্রবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নূরজাহানপুর এলাকায় দিনাজপুর-গোবিন্দগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কে দুর্ঘটনায় যে পাঁচজন বাসযাত্রী মারা যান, তাঁদের মধ্যে এরশাদ হোসেন একজন। পঞ্চগড় থেকে ঢাকাগামী নাবিল পরিবহনের ওই বাসে ঈদের ছুটি শেষে কর্মস্থলে ফিরছিলেন এরশাদ।
গতকাল শনিবার রাত আটটার দিকে এরশাদ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের ভিড়। ভেতর-বাইরের উঠানে বসে লাশের অপেক্ষা করছেন তাঁরা। ঘরের ভেতর বিছানায় বসে আহাজারি করছেন এরশাদের পক্ষাঘাতগ্রস্ত মা তহমিনা বেগম (৬০)। তাঁকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছেন স্বজনেরা। এরশাদের ছেলে আরাফাত হোসেনকে কোলে নিয়ে পাশে বসে কাঁদছেন তাঁর বড় ভাইয়ের স্ত্রী মুক্তা বেগম (৩০)। অবাক দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছে অবুঝ শিশুটি। এরশাদের বাবা, বড় ভাই, স্ত্রীসহ কয়েক স্বজন রংপুরে গেছেন লাশ আনতে।
আহাজারি করতে করতে এরশাদের মা তহমিনা বেগম বলছিলেন, ‘যাবার সময় খালি কহে (বলে) গেল, “মা, মুই গেনুগে (মা, আমি গেলাম)।” মোর বাপটার এইডায় শেষ কথা বাপু। মোর মানিকটা আসলে চলে গেল গে বাপু। এ্যাল (এখন) মোর কী হবে, মুই প্যারালাইসিসের রুগি। ওর অবুঝ বাচ্চাডার কী হবে?’
তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ ছিলেন এরশাদ হোসেন। দিনমজুর বাবার প্রায় দুই বিঘার ভিটেবাড়ি ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। এরশাদের তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। দিনমজুর বড় ভাই তাহের হাসানও বিয়ে করে সংসার করছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, কষ্ট করে পড়ালেখার পাশাপাশি রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন এরশাদ। প্রায় সাত বছর আগে এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই সেনাবাহিনীতে চাকরি হয় এরশাদ হোসেনের। এর পর থেকেই সংসারের সুখ ফেরানোর চেষ্টায় নামেন তিনি। তিন বছর আগে বিয়ে করেন। বাবার ভিটায় তিন কক্ষের একটি টিনশেড আধা পাকা ঘর দিয়েছেন। বৃদ্ধ বাবাকে ছাড়িয়েছেন দিনমজুরের কাজ থেকে। আর সম্প্রতি বড় ভাইকে ব্যাটারিচালিত একটি ভ্যান কিনতেও সহযোগিতা করেছেন তিনি। পক্ষাঘাতগ্রস্ত মায়ের চিকিৎসাসহ প্রায় সব দ্বায়িত্বই পালন করতেন এরশাদ। ৪ জুন ১০ দিনের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন। গতকাল তাঁর কর্মস্থলে যোগদানের কথা ছিল।
এরশাদের ভাবি মুক্তা বেগম বলেন, ‘আমাদের সংসারে সবাই দিনমজুর ছিলাম। এরশাদের চাকরিটা হওয়ার পর কষ্ট কিছুটা দূর হচ্ছিল। এর মধ্যেই তো তাকে হারিয়ে ফেললাম। কী হবে ওর অবুঝ বাচ্চাটার?’
কামাত কাজলদীঘি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান তোফায়েল প্রধান জানান, গতকাল রাত পৌনে ১১টার দিকে এরশাদ হোসেনের লাশ বাড়িতে আসে। সেনাবাহিনীর পঞ্চগড় ক্যাম্পের সদস্যরা তাঁকে গার্ড অব অনার দেন। পরে জানাজা শেষে দিবাগত রাত ১২টার পর তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।