জামালপুরে ফিরছে সুদিন

গত তিন বছরের মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৮০৮ হেক্টর বেশি জমিতে পাটের আবাদ করা হয়। বেড়েছে উৎপাদনও।

দেশের যে কয়েকটি জেলায় পাঠ চাষ হয়, এর মধ্যে জামালপুরের খ্যাতি বেশ পুরোনো। এ জেলায় অনেকে পাট চাষ করেন বংশপরম্পরায়। সেই ১৯০১ সালে জেলাটিতে একটি পাট ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছিল। মাঝের ছন্দপতনের পর পাটের চাহিদা বেড়েছে, বাড়ছে পাটের দাম। এতে ‘সোনালি আঁশ’-এর আবাদ নিয়ে আশাবাদী হয়ে উঠছেন কৃষকেরা।

আজ জাতীয় পাট দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য, ‘পাটশিল্পের অবদান, স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় বলছে, এই জেলার আবহাওয়া ও মাটি পাট চাষের জন্য উপযোগী। গত তিন বছর উৎপাদন বেড়েছে ১৮ হাজার ৪৪২ মেট্রিক টন। জেলায় সবচেয়ে বেশি চাষ হচ্ছে তোষাজাতীয় পাট।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জামালপুরে ২৭ হাজার ১২৫ হেক্টর জমিতে পাটের আবাদ করা হয়। উৎপাদন হয়েছিল ৩৯ হাজার ২৬৩ মেট্রিক টন। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে আবাদ হয়েছে ২৮ হাজার ৯৩৩ হেক্টর জমিতে। এ থেকে উৎপাদন হয়েছে ৫৭ হাজার ৭০৫ মেট্রিক টন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১ হাজার ৮০৮ হেক্টর বেশি জমিতে পাটের আবাদ করা হয়। এ থেকে ১৮ হাজার ৪৪২ মেট্রিক টন পাটের উৎপাদন বেড়েছে। ওই বছরে পাটের ভালো দাম পেয়েছেন কৃষকেরা। দাম বাড়তে বাড়তে একপর্যায়ে প্রতি মণ সাড়ে ছয় হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে পাটের দাম এখন কমে প্রতি মণ তিন হাজার টাকা।

পাট উৎপাদনে এ জেলার মাটি উপযোগী। বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক পাট চাষ হয়। পাট উৎপাদনের জন্য পাটের পাতা মাটিতে পড়ে জমি উর্বর হয়। বর্তমানে দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা বিজেআরআই তোষা পাট-৮ নামের এক জাতের পাট উদ্ভাবন করেছেন। জামালপুরে এ পাটের চাষই বেশি হয়।
জাকিয়া সুলতানা, জামালপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক

মেলান্দহ উপজেলার ঘোষেরপাড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ ছবিলাপুর গ্রামের আলম মিয়া বলেন, ‘এক একর জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। এবার আবারও পাট চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছি। এক একর জমিতে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হলে পাট বিক্রি করে প্রায় ২০ হাজার টাকা লাভ হতো। গত বছর বন্যার কারণে লাভ হয়নি। পানি আসার সঙ্গে সঙ্গে পাট কেটে ফেলেছিলাম। তাই পাট কম হয়েছিল।’

ইসলামপুর উপজেলার নোয়ারপাড়া ইউনিয়নের উলিয়া গ্রামের এক কৃষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কৃষকেরা পাট চাষ করে আগের থেকে এখন অনেক লাভবান হচ্ছে। তবে বীজ ও সারের নিশ্চয়তা এবং কৃষি কর্মকর্তাদের তদারকি পেলে তাঁরা পাট চাষে আরও মনোযোগী হবেন। মাঝেমধ্যে এসবের সংকটে পড়তে হয় কৃষকদের। এগুলোর সমাধান হওয়া জরুরি।

আরও কয়েকজন পাটচাষির সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, পাটের বীজ বাজার থেকে কিনে থাকেন তাঁরা। বীজ ও সারের দাম নাগালের মধ্যেই থাকে। তবে কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা মাঠে আসেন না। বেশির ভাগ কৃষক মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের চিনেন না। তাঁরা আসেন কি না, সেটাও জানেন না তাঁরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তাদের নানা স্থানে ঘোরাফেরা করতে হয়। আগের থেকে এখন মাঠপর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তা ও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক সহজ করা হয়েছে। প্রত্যেকের ফোন নম্বর দেওয়া আছে। আমি যখন নিজে মাঠে যাই, তখন আমার নম্বর পর্যন্ত দিয়ে আসি। যাতে তাঁরা আমাদের সঙ্গে সহজেই সব বিষয়ে পরামর্শ নিতে পারেন। আমি কৃষকদের বলব উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের ফোন নম্বর সংরক্ষণ করতে।’

পাট কেনাবেচার জন্য জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার গুঠাইল বাজার প্রসিদ্ধ। প্রায় ১০০ বছর ধরে ওই হাটে পাট কেনাবেচা হয়। প্রতি সপ্তাহে শুক্র ও সোমবার পাটের হাট বসে। প্রতি হাটে প্রায় ১০ হাজার মণ পাট কেনাবেচা হয়।

ওই বাজারে অন্তত ২৫ বছর ধরে পাটের ব্যবসা করছেন দেলোয়ার হোসেন (৪৫)। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও একজন পাটচাষি। এবারও সাত বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলাম। একই সঙ্গে পাটের ব্যবসা করি।

অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, পাট কেনাবেচা যদি উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, তাহলে কৃষক দাম পাবেন। লাভবান হবেন। বেশ কয়েক বছর ধরে কৃষক পাটের ভালো দাম পাচ্ছেন। গত বছর কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয় ব্যাপক লাভবান হয়েছেন। এবার কৃষক লাভবান হলেও, পাট ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।’

দেলোয়ারের মতে, পাটের সরবরাহ অনেক বেশি, কিন্তু পাইকার কম। দেশে আগে সরকার বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশনের (বিজেএমসি) মাধ্যমে পাট কিনত। সে ক্ষেত্রে পাটের দাম সরকার ঠিক করে দিত। কিন্তু এবার সরকার পাট কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়ে গেছেন।

জামালপুরের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক জাকিয়া সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, পাট উৎপাদনে এ জেলার মাটি উপযোগী। বছরের পর বছর ধরে ব্যাপক পাট চাষ হয়। পাট উৎপাদনের জন্য পাটের পাতা মাটিতে পড়ে জমি উর্বর হয়। বর্তমানে দেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা বিজেআরআই তোষা পাট-৮ নামের এক জাতের পাট উদ্ভাবন করেছেন। জামালপুরে এ পাটের চাষই বেশি হয়।