গহিন সুন্দরবনে যেভাবে ঈদ কাটে বনকর্মীদের

সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদীতে ঈদের দিন টহলে ব্যস্ত বনরক্ষীরা। বৃহস্পতিবার সকালেছবি: প্রথম আলো

ঈদের দিন মানে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ। ঈদ মানে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা। কিন্তু সবাই এমনটা করতে পারেন না। এমন মানুষের দলে আছেন সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত বন বিভাগের কর্মীরা।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ঈদের সময় চোরা শিকারি চক্র সুন্দরবনে হরিণসহ বন্য প্রাণী শিকারের অপতত্পরতা চালায়। তাই ঈদে সুন্দরবনে বন বিভাগে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীদের ছুটি বাতিল করে কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

আজ বৃহস্পতিবার ঈদের সকালে সুন্দরবনের বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন ও টহল ফাঁড়ির কয়েকজন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, সবাই একসঙ্গে ছুটিতে গেলে সুন্দরবনে নজরদারি করবেন কে? ঈদের দিন বনে থাকতে খারাপ লাগলেও সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তাঁদেরই।

সকালে সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ে গিয়ে দেখা যায়, পরিবার–পরিজন ছেড়ে সুন্দরবনে কাজ করছেন বনরক্ষীরা। কয়রা উপজেলাসংলগ্ন সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া নদী ধরে গহিন বনের সত্যপীরের খালের দিকে একটি ছোট নৌকা চালিয়ে কয়েকজন বনরক্ষী এগিয়ে চ্ছিলেন। ওই টহল দলের সদস্য নজরুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের চাকরিতে প্রায় ঈদেই ছুটি মেলে না। বিশেষ করে রোজার ঈদে বাড়িতে যেতে পারেন না। পরিবার ছাড়া ঈদ করা খুবই কষ্টের। তবে মানিয়ে নিতে হয়। একসময় খারাপ লাগত। এখন আর খারাপ লাগে না।

আরও পড়ুন

পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য কয়েক মাস ধরে গহিন সুন্দরবনে আছেন বনরক্ষী আবদুল হাকিম। তাঁর অবস্থান এখন ভোমোরখালী বন টহল ফাঁড়িতে। লোকালয় থেকে নৌযানে সেখানে পৌঁছাতে সাত-আট ঘণ্টা লাগে। পাঁচজন সহকর্মী নিয়ে সেখানেই ঈদ উদযাপন করছেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি বরিশালে। মা–বাবা পরিবারসহ সেখানেই থাকেন। আমার জঙ্গলে চাকরির গত পাঁচ বছরে একটি ঈদ পরিবারের সঙ্গে কাটিয়েছি। বাকি সব সুন্দরবনে। মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে পারছি না বলে একটু তো মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু দায়িত্ব আরও বড় বিষয়। মূলত ঈদের সময়টায় যাতে কেউ সুন্দরবনের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য সারাক্ষণ টহলে থাকতে হয়।’

আবদুল হাকিম জানান, এক বছর পরপর তাঁদের বদলির নিয়ম। সুন্দরবনের গহিনে হলেও মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের নেটওয়ার্ক আছে কোথাও কোথাও। মাঝেমধ্যে সেটা থেকেই যোগাযোগ হয় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে।

সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জে ২০১৮ সাল থেকে আছি। এর মধ্যে একবার মাত্র পরিবারের সঙ্গে ঈদ করতে পেরেছি। গত বছর ঈদের সময় সুন্দরবনের পাতকোষ্টা টহল ফাঁড়িতে কর্মরত ছিলাম। গহিন বনের ওই এলাকায় মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও পাওয়া যায় না। ঈদের দিন আমরা পাঁচজন স্টাফ মিলে একটি মুরগি জবাই করে আর একটু সেমাই রান্না করে নিজেদের মতো করে ঈদ পালন করেছিলাম। এবারও তা– করছি।’

বন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘আসলে চাকরির জন্য সবকিছু মেনে নিতে হয়। আমার দুই সন্তান। ছেলেটা পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে আর মেয়েটা এবার স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। গত পরশু ছোট মেয়েটা ফোন করে বলেছে, “আব্বু বাড়ি আসবা কবে?” আমি বললাম, আম্মু এবার একটু দেরি হবে। মেয়ে আবার জিজ্ঞেস করে, কত দিন দেরি হবে? আমি আর কিছু বলিনি। কারণ, কোনো একটা তারিখ বললে ক্যালেন্ডারের পাতায় ওই তারিখে দাগ দিয়ে রেখে দিন গুনতে থাকে।’

আরও পড়ুন

সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা নির্মল মন্ডল বলেন, ‘আজ পরিবার–প্রিয়জন নিয়ে সবাই যখন ঈদ আনন্দ উপভোগ করছেন, ঠিক এ সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে আমরা অবস্থান করছি নির্জন সুন্দরবনে। আমি সনাতন ধর্মাবলম্বী হওয়ায় কয়েকজনকে ঈদের নামাজ পড়তে লোকালয়ে পাঠিয়ে দিয়ে আমি বনে টহল করছি। নামাজ শেষ হলে অন্যরাও টহলে যোগ দেবে। এই যে সবাই মিলেমিশে কাজ করছি, এর মাধ্যমেই গড়ে ওঠে সম্প্রীতির বন্ধন।’

সুন্দরবনের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশন কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘পরিবার থেকে দূরে থাকলেও আমার স্টেশনটি লোকালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছি। কিন্তু সুন্দরবনের পাতকোষ্টা, কাগাদোবেকি, গেওয়াখালী, আদাচাই, ভদ্রা, পাশাখালীসহ আমাদের অনেকগুলো টহল ফাঁড়ি রয়েছে গহিন বনের মধ্যে। যেখানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই। ওই সব জায়গায় যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা ঈদের নামাজও পড়তে পারেন না। ঈদের কয়েক দিন আগে লোকালয়ে এসে পানি আর বাজার-সদাই নিয়ে গেছেন। হয়তো আজ নিজেরাই সেমাই রান্না করে খাচ্ছেন।’

আরও পড়ুন

বন কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু শুধু বন বিভাগ সব ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। দুর্গম ও ভয়ংকর বনাঞ্চলে বনপ্রহরীদের সব সময় জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়। বেতন ছাড়া অন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।

সুন্দরবন খুলনা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, যেকোনো ছুটির সময় দুর্বৃত্তরা বনের সম্পদ লুটপাট ও ধ্বংসের সুযোগ নিতে চায়। এ কারণে এ বছরও সুন্দরবনের ভেতর সব ফরেস্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঈদের ছুটি বাতিল করে নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।