সিঁদুরে রাঙা ‘বিষাদময় উৎসব’
সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ছিল। ভিজতে ভিজতেই পুণ্যার্থীরা এলেন রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমে। শহর সিলেটের নাইওরপুল এলাকায় মিশনের অবস্থান। সেখানেই চলছিল দশমীর বিহিত পূজা আর দর্পণের আনুষ্ঠানিকতা। যখন পূজা চলছিল, তখন প্রতিমার সামনে ছিলেন কয়েক শ নারী, পুরুষ ও শিশু।
এটি আজ মঙ্গলবারের দৃশ্য। সকাল ৯টা ৪৯ মিনিটে দশমী তিথি শেষ হওয়ার পরই মণ্ডপের সামনে থাকা নারীরা প্রতিমার কাছে ছুটে যান। সবার হাতেই ছিল থালা। সেখানে রাখা সিঁদুর, দূর্বা, ধান আর মিষ্টি। প্রতিমাকে সিঁদুরে রাঙিয়ে মিষ্টিমুখ করিয়ে এক বছরের জন্য দেবী দুর্গাকে বিদায় জানান নারীরা। তবে দেবী বিদায়ের মন খারাপের এমন মুহূর্তেও নারীরা হাসিমুখে একে অন্যকে সিঁদুরে রাঙিয়ে দেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, দর্পণের পরপরই নারীরা মেতেছেন সিঁদুর খেলায়। নারীদের অনেকের পরনে ছিল লালপেড়ে শাড়ি, সোনার গয়নায় ঝলমলে। দেবী দুর্গাকে বিসর্জনের মুহূর্তে মনের কোণে বিষাদ রেখেও আনন্দে মাতেন তাঁরা। মঙ্গল কামনা করে একজন আরেকজনের গালে-কপালে সিঁদুরে রাঙিয়ে দেন। প্রায় সব নারীর গালে ছিল সিঁদুরের ছোপ, তাঁদের আঙুল হয়েছে লাল। কারও কারও কপালে ছিল সিঁদুরের চওড়া তিলক। বিবাহিত নারীদের পাশাপাশি তরুণী ও শিশুদেরও সিঁদুর খেলায় অংশ নিতে দেখা গেছে।
এক নারীর গালে সিঁদুর লাগিয়ে দিচ্ছিলেন মিতালী ধর (৫৯) নামের এক নারী। নগরের দাড়িয়াপাড়া এলাকার এই বাসিন্দা একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন। তিনি বলেন, তাঁর বিয়ে হয়েছে ২৬ বছর আগে। বিয়ের পর থেকে তিনি প্রতিবার বিজয়া দশমীর দিন সিলেটের রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমে সিঁদুর খেলায় অংশ নিয়েছেন। স্বামী ও পরিবারের সৌভাগ্য কামনায় তিনি এমন রীতি পালন করে আসছেন।
কবে থেকে রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে সিঁদুর খেলা হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রমের সম্পাদক স্বামী চন্দ্রনাথানন্দজি মহারাজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিঁদুর খেলা এখানে আনুষ্ঠানিকভাবে হয় না। তবে নারীরা বিহিত পূজা ও দর্পণ শেষে প্রতিমাকে সিঁদুরে রাঙিয়ে একে অন্যকে সিঁদুর মাখিয়ে দেন।’
রামকৃষ্ণ মিশন ও আশ্রম সূত্রে জানা গেছে, ১৯১৩ সালে আশ্রমটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে কবে থেকে এখানে দুর্গাপূজার চল শুরু হয়েছে, এর কোনো ইতিহাস জানা যায় না। তবে মিশনে দুর্গাপূজা শুরু হওয়ার পর থেকেই বাঙালির প্রথাগত রীতি অনুযায়ী সিঁদুর খেলা শুরু হয়েছে বলে মিশনসংশ্লিষ্ট কয়েকজন মনে করেন।
স্বামী-সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রামকৃষ্ণ মিশনে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী অদিতি ধর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৮ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে। এরপর প্রতিবারই মিশনে এসে দেবীকে বিদায় জানানোর পাশাপাশি সিঁদুর খেলায় অংশ নিয়েছি। বরাবরের মতো এবারও এলাম।’
সিঁদুরে রাঙা ‘বিষাদময় উৎসবের’ পাশাপাশি মণ্ডপের উল্টো দিকে প্রসাদ বিতরণ করা হচ্ছিল। প্রসাদ নিতে সেখানে নারী, পুরুষেরা ভিড় জমান। কেউ কেউ সিঁদুর খেলা শেষে মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন। যেতে যেতে তাঁদের অনেকে বলছিলেন, দেবীকে আনুষ্ঠানিক বিসর্জন জানাতে তাঁদের আবার বিকেলে মিশন ও আশ্রমে আসতে হবে।