পদ্মার ভাঙনে বিলীন পাকা ভবনসহ পাঁচটি ঘর, হুমকিতে অর্ধশত পরিবার

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের বড়নওপাড়া এলাকায় পদ্মা নদীতে আকস্মিক ভাঙন দেখা দিয়েছে। শুক্রবার দুপুরে বড়নওপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের বড়নওপাড়া এলাকায় পদ্মা নদীতে আকস্মিক ভাঙন দেখা দিয়েছে। পদ্মার ভাঙনে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে একটি পাকা ভবনসহ পাঁচটি ঘর বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে বহুতল ভবনসহ অর্ধশত বাড়িঘর।

আকস্মিক নদীভাঙনে চরম আতঙ্কে আছেন নদীতীরবর্তী বাসিন্দারা। অনেকে ঘরবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। গতকাল রাতের ভাঙনে লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নের বড়নওপাড়া এলাকার ইকবাল হোসেন মৃধা, যীতেন রাজবংশী, সুধন রাজবংশী, কামরুজ্জামান ও স্বপন রাজবংশীর বাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে।

আজ শুক্রবার দুপুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, আতঙ্কগ্রস্ত বাসিন্দারা বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। ঘর সরিয়ে নিতে মিস্ত্রিদের হাতুড়িপেটা ও কুড়াল দিয়ে গাছ কাটতে দেখা যায়। ভাঙনকবলিত বাসিন্দাদের চোখেমুখে ছিল হতাশা ও আতঙ্কের ছাপ। টানা বৃষ্টি, নদীর ঢেউ ও প্রচণ্ড স্রোতে নদীপারের বাসিন্দারা দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

ভাঙনের শিকার ইকবাল মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, নদীশাসনের সময় এভাবে ঘর বিলীন হবে, কেউ ভাবতে পারেননি। তাঁর তিনটি ঘরের মধ্যে একটি বিলীন হয়ে গেছে। একটি সরিয়ে নিয়েছেন। অন্যটিও সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, বর্তমান জায়গায় প্রায় ১০০ বছরের বসতি তাঁদের। ২৫ বছর আগে বাড়ির এক একর জমি পদ্মার পেটে চলে যায়। এখন শেষ সম্বলটুকুও হারাতে বসেছেন।

সুধন রাজবংশী বলেন, বৃষ্টির মধ্যে গতকাল রাতে হঠাৎ ভাঙন শুরু হয়। মুহূর্তেই মাটি ভেঙে পড়তে থাকে। ঘরের আসবাব বের করেন। বেড়া সরানোর সময় ঘর নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, আজ সকাল থেকে হঠাৎ তীব্র ভাঙন শুরু হয় বড়নওপাড়ায়। মুহূর্তেই চারটি বসতবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। পরে ভাঙন–আতঙ্কে আরও ১৫টি বসতঘর সরিয়ে নেওয়া হয়। এতে গৃহহীন হয়ে পড়ে প্রায় ২০টি পরিবার। দ্রুত ভাঙন ঠেকানো না গেলে অন্তত অর্ধশত বাড়িঘর ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে। ভাঙন ঠেকাতে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নে পদ্মার ভাঙনে পাকা ভবনসহ পাঁচটি ঘর নদীতে বিলীন হয়েছে। শুক্রবার দুপুরে বড়নওপাড়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

ভাঙন–আতঙ্কে থাকা পরিবারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে স্বপন রাজবংশীদের দোতলা একটি ভবন। ভাঙন চলে গেছে ভবনের কাছাকাছি। স্বপন রাজবংশী বলেন, ‘আমরা ছয় ভাই জেলের কাজ করি। আট বছর আগে পাঁচতলা ভবনের কাজ শুরু করি। একটু একটু করে টাকা জমিয়ে তিন বছর আগে একতলার কাজ শেষ করেছিলাম। সেখানে মা ও বড় ভাই থাকতেন। সবেমাত্র দোতলার কাজ ধরেছি। এর মধ্যে পদ্মায় ভাঙন শুরু হয়। জীবনের সব সঞ্চয় লাগিয়েছি ভবনটি করতে। ভবনটি নদীতে বিলীন হয়ে গেলে পথে বসা ছাড়া উপায় থাকবে না।’

এর আগেও লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নে পদ্মার ভাঙন দেখা দেয়। সর্বশেষ গত বছরের মে মাসে ইউনিয়নটির ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বড়নওপাড়া ভাঙনের কবলে পড়ে। এতে অর্ধশত পরিবারের ভিটেমাটি ও আবাদি জমি নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

ভাঙনের বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ভাঙতে ভাঙতে ইউনিয়নটি প্রতিবছর ছোট হচ্ছে। ভাঙন রোধে সরকার ৫০০ কোটি টাকার যে প্রকল্প নিয়েছে, তাতে বড়নওপাড়াও আছে। ঠিকমতো ভাঙন প্রতিরোধে কাজ চলছিল। মাঝে এক মাসের মতো প্রকল্পের কাজ বন্ধ ছিল। বন্ধ না থাকলে ভাঙন না–ও হতে পারত। আজকের ভাঙনে ১৫টি পরিবারের ২৫টি বাড়ি পদ্মায় বিলীন হয়েছে। বিষয়টি মৌখিকভাবে উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। আগামী রোববার লিখিতভাবে তাঁদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে জানানো হবে।

লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ভাঙনের খবরে তিনবার ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছেন। সেখানকার ভাঙন নিয়ন্ত্রণে ইতিমধ্যে তিন হাজার বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। ভাঙন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের দিকে। ভাঙন বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত জিও ব্যাগ ফেলা হবে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসনে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

পদ্মার ভাঙন রোধে ২০২২ সালের ১৮ মে পদ্মার বাম তীর নামে লৌহজংয়ের খড়িয়া থেকে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার দিঘীরপাড় পর্যন্ত ৯ দশমিক ১০ কিলোমিটার অংশে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন পানিসম্পদমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক। ৪৪৬ কোটি টাকা ব্যয়ে কাজটি শুরু হয়। পরে লৌহজংয়ের লৌহজং-তেউটিয়া ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দেয়। চলতি বছর আরও ৪ দশমিক ৬২ কিলোমিটার বাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৭২ কিলোমিটারের কাজ শুরু হয়েছে। এতে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৭৮ কোটি টাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের মুন্সিগঞ্জ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী নরেন্দ্র শংকর চক্রবর্ত্তী প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, উজানের পানি পদ্মা হয়ে সাগরের দিকে যাওয়ায় নদীতে প্রচণ্ড স্রোত বইছে। মূল পদ্মায় চর জেগেছে। সে জন্য জলযানগুলো নদীর এ অংশের তীর ঘেঁষে যাতায়াত করছিল। স্রোতে হঠাৎ নদীর তলদেশ থেকে মাটি ও জিও ব্যাগ সরে গিয়ে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ভাঙন প্রতিরোধে জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এ অংশ পদ্মার বাম তীর প্রকল্পের মধ্যে পড়েছে। ইতিমধ্যে এ অংশের ২০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। শিগগির ভাঙনকবলিত অংশে জিও ব্যাগের মধ্যে বালু-সিমেন্ট মিশ্রিত করে অস্থায়ী প্রতিরক্ষাকাজ করা হবে।