‘সন্তানকে না দিতে পারছি পিন্ধন, না খাওন’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা জয় করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন জসিম উদ্দীন
ছবি: প্রথম আলো

বেশভূষা মলিন। আলোহীন দুই চোখ তাঁর। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিলিয়ে কথা বলেন মাঝেমধ্যে। পৃথিবীর রূপ-রং কিছুই দেখার সৌভাগ্য হয়নি। একবেলা খাবার জোটে তো আরেক বেলা জোটে না। তবু মুখে তাঁর দৃঢ়প্রত্যয়। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা জয় করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন লক্ষ্মীপুরের মো. জসিম উদ্দীন (৩২)। তবে এখন আর্থিক সংকটে জসিমের দিন কাটছে কষ্টে।

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার চর রুহিতা গ্রামের শামসুল হকের ছেলে জসিম উদ্দীন। জন্মের এক বছর বয়স থেকেই তিনি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। কিন্তু তাঁর এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা লেখাপড়ার ক্ষেত্রে বাধা হতে পারেনি। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীর কারণে পরীক্ষার হলে একজন সহকারী নেন। জসিম মুখে বলেন আর ওই ব্যক্তি পরীক্ষার খাতায় তা হুবহু লেখেন। এভাবে পড়াশোনা করে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি। বছর তিনেক আগে লক্ষ্মীপুর বিসিক শিল্প এলাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ছোট চাকরি নেন জসিম। এ জন্য পাঁচ হাজার টাকা বেতন পান তিনি। কিন্তু ওই বেতনও তিন মাস ধরে বকেয়া।

দৃষ্টিহীন হয়েও শত বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে এসেছেন জীবনের অনেকটি বছর। কিন্তু যুবক বয়সে এসে অনেকটা ব্যর্থ জসিম। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা বেতনে তাঁর সংসার চলেছে না আর। তিন বছরের মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া ও স্ত্রী নিয়ে জসিমের সংসার। তবে অল্প আয় দিয়ে সন্তানের জন্য পছন্দমতো বাজার-সদাই করতে পারছেন না তিনি। গতকাল মঙ্গলবার লক্ষ্মীপুর প্রেসক্লাবে কথা হয় জসিমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা যখন করেছি, ভিক্ষা করব কেন? ভিক্ষা করতে চাই না। চাকরি করে বাঁচতে চাই। কিন্তু এই চাকরি করে সন্তানকে না দিতে পারছি পিন্ধন, না খাওন। মেয়েটা চার মাস ধরে মুরগির মাংস খাওয়ার জন্য কান্না করতেছে। কিন্তু একটা মুরগি কেনাও সম্ভব হচ্ছে না।’

জসিমের বাবা শামসুল হক কৃষিকাজ করেন। পাশাপাশি একটি চায়ের দোকান চালান তিনি। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে জসিম সবার বড়। জসিমের ছোট ভাই কৃষিকাজ করেন। তিন বোনের মধ্যে দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। এক চিলতে জমির ওপর বাবার তৈরি করা জরাজীর্ণ বাড়িতে থাকেন জসিম। তাঁর বাবা বা ছোট ভাইয়েরও আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সহায়সম্বল বলতে বসতভিটা ছাড়া আর কিছু নেই তাঁদের। তাই নিজের আয়ের ওপর নির্ভর করেই জসিমকে চলতে হয়।

বসতভিটা ছাড়া আর কিছু নেই জসিম উদ্দীনের
ছবি: প্রথম আলো

২০২২ সালে একটি ঘরের জন্য জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন জসিম। জেলা প্রশাসক এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দিয়েছেন। কিন্তু আজও ঘরটি জোটেনি। জসিম বলেন, ‘আমি সব সময়ই ভাবতাম, পড়াশোনা করেই আমাদের মতো ছেলেদের বড় হতে হবে। ফলে শত কষ্টের মধ্যেও পড়াশোনা ছাড়া অন্য কোনো চিন্তা করিনি। যদিও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য পড়াশোনা অনেক চ্যালেঞ্জ। তার ওপর আমরা দরিদ্র। এখন জিনিসপত্রে দাম যেভাবে বাড়ছে, তাতে কীভাবে সংসার চলবে, তা ভেবে কূলকিনারা করতে পারছি না।’

জানতে চাইলে সদর উপজেলার চর রুহিতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন কবির পাটোয়ারী বলেন, ‘দৃষ্টিহীন জসিম অর্থনৈতিক সংকটে আছেন। জসিম একটি ঘরের জন্য আবেদন করেছিলেন। বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। আমিও মাঝেমধ্যে সুযোগ পেলে জসিমকে সহায়তা করি।’