সরকারি প্রাথমিকে শিক্ষকের চাকরি পেতে ৮ লাখ টাকা দিয়েছিলেন ললিত

পঞ্চগড় জেলার মানচিত্র

ভ্রাম্যমাণ কম্পিউটার টাইপিস্ট হিসেবে কাজ করতেন ললিত মোহন রায় (২৬)। এ কাজের সূত্রে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ঠাকুরগাঁও জেলার এলিট সমবায় সমিতি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মো. রিয়াজুল ইসলামের (৩২)। এরপর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করার বিষয়টি রিয়াজুলের সঙ্গে আলাপ করেন ললিত। লিখিত পরীক্ষার আগে রিয়াজুল ললিতকে বলেন, ১০ লাখ টাকা দিতে পারলে চাকরির ব্যবস্থা করে দেবেন। এমনকি লিখিত পরীক্ষাও অন্যজন দিয়ে দেওয়ানোর ব্যবস্থা করবেন।

এরপর ললিতের হয়ে অন্য একজন লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। পরে ললিত বসতভিটার অর্ধেক বিক্রি করে রিয়াজুলকে পাঁচ লাখ টাকা দেন। এর মধ্যে লিখিত পরীক্ষায় পাস করেন। মৌখিক পরীক্ষার দিন ধার্য হয়। ওই পরীক্ষার আগের দিন গত সোমবার রিয়াজুলের সমিতি কার্যালয়ে বোদা উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে তিন লাখ টাকা তুলে দেন ললিত।

গ্রেপ্তার ললিত মোহনের আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং মামলার তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে বলে আজ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পঞ্চগড় সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শামসুজ্জোহা সরকার।

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, বোদা উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামের এক আত্মীয় এলিট সমবায় সমিতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর মাধ্যমে রিয়াজুলের সঙ্গে রফিকুল ইসলামের যোগাযোগ হয়। ললিতকে লিখিত পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষার জন্য রফিকুল ইসলামকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন রিয়াজুল। রফিকুল ইসলাম তাঁর সঙ্গে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসকের ভালো সম্পর্ক ও মৌখিক পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেন। এ জন্য তাঁকে তিন লাখ টাকা দেওয়া হয়।

রফিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পর তিন লাখ টাকা উদ্ধার করা হয় জানিয়ে শামসুজ্জোহা সরকার বলেন, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে পঞ্চগড় জেলায় এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হওয়া মোট সাতজনের মধ্যে পাঁচজনই পরীক্ষার্থী ছিলেন। কিন্তু কেউই বলতে পারছেন না, তাঁদের লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন কে।

গত মঙ্গলবার রাতে পঞ্চগড়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে বোদা উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম (৪১) ও চাকরিপ্রার্থী ললিত মোহন রায়কে (২৬) পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে আটক করে পুলিশ। ওই রাতে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শহীদুল ইসলাম বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও দু–তিনজনকে আসামি করে পঞ্চগড় সদর থানায় একটি মামলা করেন।

আরও পড়ুন

ওই মামলায় রাতে রফিকুল ইসলাম ও ললিত মোহনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। রফিকুল ইসলামের বাড়ি ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার পূর্বগোয়ালপাড়া এলাকায়। আর ললিত মোহন রায়ের বাড়ি পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার পাঁচপীর ইউনিয়নের দক্ষিণ কালীবাড়ি এলাকায়।

মামলার এজাহারভুক্ত অপর আসামি মো. রিয়াজুল ইসলাম (৩২) ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার জগন্নাথপুর ইউনিয়নের চণ্ডীপুর এলাকার বাসিন্দা ও এলিট সমবায় সমিতির সভাপতি। বর্তমানে তিনি পলাতক।

গত বুধবার বিকেলে রফিকুল ইসলাম ও ললিত মোহনকে পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা হয়। পুলিশ রফিকুল ইসলামের তিন দিনের রিমান্ড আবেদন করলে আদালতের বিচারক আগামী রোববার রিমান্ড শুনানির দিন নির্ধারণ করে তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। অপর আসামি ললিত মোহন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত।

পুলিশ ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার সকাল থেকে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগের লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ বোদা উপজেলার চাকরিপ্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছিল। বিকেল চারটার দিকে ভাইভা বোর্ডে চাকরিপ্রার্থী ললিত মোহনের লিখিত পরীক্ষার খাতার সঙ্গে মৌখিক পরীক্ষার হাতের লেখার অমিল পাওয়া যায়। বিষয়টি নিয়োগ বোর্ডের সদস্যদের সন্দেহ হলে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

এ সময় ললিত বসতভিটার অর্ধেক বিক্রি করে একটি চক্রকে আট লাখ টাকা দেওয়ার কথা স্বীকার করেন। তাঁর লিখিত পরীক্ষা অন্য একজন দিয়ে দিয়েছেন বলেও জানান। তবে লিখিত পরীক্ষায় তাঁর পরিবর্তে কে অংশ নিয়েছেন, তা বলতে পারেননি।

নিয়োগে বোর্ডের জিজ্ঞাসাকালে বোদা উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকে তিন লাখ টাকা এবং রিয়াজুল ইসলামকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়ার কথা জানান ললিত মোহন। এরপর সন্ধ্যায় রফিকুল ইসলামকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ডেকে আনা হয়। পরে দুজনকেই পঞ্চগড় সদর থানা–পুলিশে সোপর্দ করে নিয়োগ বোর্ড।