সবজি বেচাবিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ ও অন্যতম পাইকারি মোকাম মহাস্থান হাট ইজারায় রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ উঠেছে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। গতকাল শনিবার ছুটির দিনে তড়িঘড়ি করে হাট ইজারা কমিটির জরুরি সভা ডেকে সদস্যদের কাছ থেকে দ্বিতীয় দরদাতার নামে হাট ইজারার নথিতে স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করেছেন শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)।
অভিযোগ উঠেছে, মহাস্থান হাট থেকে আগামী ১ বৈশাখ থেকে পরবর্তী ৩০ চৈত্র পর্যন্ত খাজনা আদায়ে ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা সর্বোচ্চ ডাক উঠলেও কারসাজি করে তা ৮ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০ টাকায় দ্বিতীয় দরদাতাকে ইজারা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। এতে সরকারের ৫৭ লাখ ৪৯ হাজার ৯৫০ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে। এই রাজস্ব ক্ষতির সঙ্গে ভ্যাট ১৫ শতাংশ ও আয়কর ১০ শতাংশ যুক্ত হবে। অর্থাৎ আরও ১৪ লাখ ৩৭ হাজার ৪৮৭ টাকা ক্ষতি হবে। সব মিলিয়ে ৭১ লাখ ৮৭ হাজার ৪৩৭ টাকার রাজস্ব ক্ষতি হবে।
একাধিক ইজারাদার অভিযোগ করে বলেন, দ্বিতীয় দরদাতা বগুড়া-৬ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য এবং বগুড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাগেবুল আহসানের শ্যালক। রাগেবুল আহসান মহাস্থান হাটের বর্তমান ইজারাদার। সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি শ্যালকের নামে এবারও এই হাট ইজারা নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শিবগঞ্জের মহাস্থান হাটসহ ১৯টি হাট আগামী ১ বৈশাখ থেকে ৩০ চৈত্র পর্যন্ত ইজারা প্রদানের জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে ২৩ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক মহাস্থান হাট ইজারা নিতে কয়েকজন ব্যক্তি দরপত্র দাখিল করেন। ১৬ ফেব্রুয়ারি ছিল ইজারা দরপত্র গ্রহণের শেষ দিন। বেলা তিনটায় দরপত্র খোলার নির্ধারিত সময়ে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের উপস্থিতিতে মহাস্থান হাটের সর্বোচ্চ দরদাতা সদরের কানাই লাল জয়শোয়ালের নাম ঘোষণা করেন ইউএনও উম্মে কুলসুম সম্পা। কানাই লাল মহাস্থান হাটের ইজারা মূল্য সর্বোচ্চ ৮ কোটি ৬০ লাখ টাকা ডেকেছেন বলেও উল্লেখ করেন ইউএনও। নিয়ম অনুযায়ী, হাট ইজারা কমিটির অনুকূলে ইজারা ডাকের অর্থ জমা দেওয়ার জন্য বলেন তিনি।
দরপত্র খোলার দিন সবার উপস্থিতিতে ইউএনও উম্মে কুলসুম সর্বোচ্চ দরদাতা আরকে এন্টারপ্রাইজের কানাই লালের নাম ঘোষণা করেন। ৮ কোটি ২ লাখ ৫০ হাজার ৫০ টাকা দর দেওয়ায় দ্বিতীয় দরদাতা হিসেবে খান এন্টারপ্রাইজের শফিকুল ইসলামের নাম ঘোষণা করা হয়। কিন্তু দুই দিন পর গতকাল শনিবার ছুটির দিনে ইউএনও হাট ইজারা কমিটির জরুরি সভা ডেকে বলেন, কানাই লাল সর্বোচ্চ দরদাতা হলেও তিনি দরপত্রের সঙ্গে পে–অর্ডার জমা দেননি। এতে দ্বিতীয় দরদাতার অনুকূলে হাট ইজারা দেওয়ার পক্ষে মতামত দেন তিনি।
শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘ছুটির দিনে সরকারি দপ্তরে সাধারণত কোনো সভা ডাকার নিয়ম নেই। কিন্তু ইউএনও অতি উৎসাহী হয়ে দ্বিতীয় দরদাতাকে হাট ইজারা দিতে গতকাল ছুটির দিনে নোটিশ ছাড়াই মৌখিকভাবে ইজারা কমিটির সভা ডেকে সদস্যদের স্বাক্ষর নেওয়ার চেষ্টা করেন। সর্বোচ্চ দরদাতাকে তলব না করে ইউএনও দ্বিতীয় দরদাতাকে ডেকে তাঁর নামে হাট অনুমোদন দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্রায় ৭২ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি হওয়ায় উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হিসেবে আমি ছাড়াও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান এবং রায়নগর ইউনিয়ন ইউপি চেয়ারম্যান ইউএনওর এ হঠকারীমূলক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করি। বিরোধিতার মুখে তিনি কয়েকজন সদস্যের স্বাক্ষর নিতে ব্যর্থ হন।’
ফিরোজ আহমেদ আরও বলেন, মহাস্থান হাট বর্তমানে ভ্যাট ও আয়করসহ প্রায় ৬ কোটি টাকায় ইজারা দেওয়া আছে সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের নামে। উপনির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এবার নিজের নামে হাট ইজারা না নিয়ে তাঁর শ্যালক শফিকুল ইসলাম খানের নামে মহাস্থান হাট ইজারা নেওয়ার কৌশল নিয়েছেন। এতে সর্বোচ্চ দরদাতার পে–অর্ডার গায়েব করে সংসদ সদস্যের আত্মীয়কে হাট ইজারা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে। মৌখিকভাবে জেলা প্রশাসকের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করা হয়েছে।
মহাস্থান হাটের রাজস্ব আয় দিয়ে চলে রায়নগর ইউনিয়ন পরিষদ। রায়নগর ইউপি চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছুটির দিনে সভা ডেকে দ্বিতীয় দরদাতাকে হাট ইজারা দেওয়ার চেষ্টার আমরা প্রতিবাদ করি। সভায় দ্বিতীয় দরদাতাকে ডেকে নেওয়া হলেও সর্বোচ্চ দরদাতাকে সেখানে তলব করা হয়নি। আমরা ইউএনওকে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, সর্বোচ্চ দরদাতার দরপত্র থেকে পে–অর্ডার গায়েব হওয়ার সঠিক তদন্ত করতে হবে।’
শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, কোন ব্যাংক থেকে পে–অর্ডার করা হয়েছে দরপত্রে তা উল্লেখ আছে। ব্যাংক থেকে প্রতিবেদন নিতে হবে। আর তদন্তে ইচ্ছাকৃতভাবে পে–অর্ডার না দিয়ে দরপত্র দাখিল প্রমাণিত হলে ওই ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তাঁকে কালোতালিকাভুক্ত করতে হবে। প্রায় ৭২ লাখ টাকা রাজস্ব ক্ষতি করে দ্বিতীয় দরদাতাকে হাট ইজারা না দিয়ে পুনঃ দরপত্র আহ্বান করতে হবে।
একজন ইজারাদার অভিযোগ করে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বগুড়ার অধিকাংশ বড় বড় হাট ডেকে নিয়েছেন ইজারাদার কানাই লাল। এবারও তিনি দুপচাঁচিয়ার ধাপেরহাট এবং শিবগঞ্জের মহাস্থান হাট ডাকে অংশ নেন। পরে সমঝোতার ভিত্তিতে ধাপেরহাট কানাই লাল ডেকে নেন ও মহাস্থান হাট সংসদ সদস্য রাগেবুল আহসানের শ্যালককে ছেড়ে দিতেই ইউএনওকে ম্যানেজ করে পে–অর্ডার সরিয়ে নিয়েছেন।
তবে কানাই লাল জয়শোয়াল বলেন, ‘দরপত্রের সঙ্গে পে–অর্ডার দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।’
জানতে চাইলে ইউএনও উম্মে কুলসুম সম্পা প্রথম আলোকে বলেন, অনেক সময় ছুটির দিনেও জরুরি দাপ্তরিক কাজ কারতে হয়। তবে গতকাল হাট ইজারা কমিটির সভা ডাকা হয়নি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির সভা হয়েছে।
ইউএনওর দাবি, ১৬ ফেব্রুয়ারি মহাস্থান হাটের সর্বোচ্চ দরদাতা কানাই লালের নাম ঘোষণা করা হলেও ওই দিন দরপত্রের সঙ্গে পে–অর্ডার নেই, তা নজরে আসেনি। পে–অর্ডার না থাকার বিষয়টি যাচাই–বাছাই করতে গিয়ে মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের নজরে আসার পর গতকাল মূল্যায়ন কমিটি সভা ডাকে। সর্বোচ্চ দরদাতার দরপত্র ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় তা বাতিল করে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতাকে হাট ইজারা প্রদান করা হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি যথাযথ তদন্ত করে খতিয়ে দেখতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) উজ্জল কুমার ঘোষকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনোভাবেই হাট ইজারায় অনিয়ম বরদাশত করা হবে না।