‘৪৫ দিনের শিশুকেও পিতৃহীন করে দিল ওরা’
মাগুরা সদর উপজেলার আলোকদিয়া গ্রামে প্রতিবেশীর ছুরিকাঘাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও একজন মারা গেছেন। গতকাল সোমবার দিবাগত রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান শিপন শেখ (২৭) নামের এই ব্যক্তি।
আগের দিন রোববার রাতের ওই ঘটনায় শিপন শেখের ভাতিজা মো. হাসান ইসলাম (২২) ঘটনাস্থলে মারা যান। এ ঘটনায় আহত হয়েছিলেন হাসান ইসলামের বাবা আলোকদিয়া গ্রামের বাসিন্দা নির্মাণশ্রমিক পাঞ্জু শেখ ও শিপন শেখের ভাই মিজান শেখ। তাঁরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিবদমান দুটি পক্ষের বাড়ি পাশাপাশি। রোববার রাত সাড়ে ১২টার দিকে আলোকদিয়া গ্রামের বাসিন্দা আলম মোল্লার ঘরে উঁকি দেওয়ার অভিযোগে রিপন শেখ নামের একজনকে আটক করেন ওই বাড়ির লোকজন। পরিবারের দাবি, রিপন মানসিকভাবে অসুস্থ। তুচ্ছ ঘটনায় তাঁকে ধরে একটি গাছে বেঁধে মারধর আলম মোল্লা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। খবর পেয়ে রিপনকে উদ্ধার করতে যান তাঁর আপন দুই ভাই মিজান শেখ, শিপন শেখ, চাচাতো ভাই পাঞ্জু শেখ ও ভাতিজা হাসান ইসলাম। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে আলম মোল্লার ছেলে আল আমিন মোল্লা (২৩) ঘর থেকে ছুরি এনে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে হাসানসহ চারজনকে জখম করেন। তাঁদের মাগুরা সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক হাসান শেখকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার হাসানের মরদেহ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়। এর মধ্যে রাত সাড়ে ১০টার দিকে হাসানের চাচা শিপন শেখের মৃত্যুর খবর আসে।
এক পক্ষ বাড়িছাড়া, অন্যদিকে কান্নার রোল
বিবদমান দুটি পক্ষের বাড়ি পাশাপাশি। দুটি বাড়ির উঠান একই। মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, নিহত হাসান ইসলামের মা চম্পা বেগম স্বজনদের ধরে আহাজারি করছিলেন। তিনি বলেন, ‘রাতের বেলা আমি ওর বাপকে কলাম তুমি যায়ে না। কিন্তু চাচাতো ভাইরে ধরে গাছে বান্দে বাড়োচ্ছে শুনে সে আর আমার ছেলে গেল। আমার ছেলেরে কোপানোর পর সে কচ্ছিল মা আমি মরে গেলাম রে। আমার ওড়না দিয়ে ছেলের রক্ত আটকানোর চেষ্টা করলাম; কিন্তু ছেলেটা আমার মারা গেল। আমার বুক খালি করে দিল।’
চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া শিপন শেখ ছিলেন পেশায় রিকশাচালক। টিনের ছাউনি দেওয়া কাঁচা ছোট একটি ঘরে স্ত্রী, পাঁচ বছরের এক মেয়ে ও ৪৫ দিন বয়সী এক ছেলে নিয়ে ছিল তাঁর বসবাস। রাতে স্বামীর মৃত্যুর খবরে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা স্ত্রী নাসরিন বেগমের। শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে এই নারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ৪৫ দিন বয়সী এই ছেলেকেও ওরা পিতৃহীন করে দিল। ভাইকে বাঁচাতে গিছিল সে, এই ছিল তাঁর অপরাধ। এই অবুঝ ছেলে মে নিয়ে আমি কীভাবে চলব? আমি ওগের সবার ফাঁসি চাই।’
এ ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা ঘটনার পরপরই বাড়ি ছেলে পালিয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। সোমবার আলম মোল্লা তাঁর ভাই সালাম মোল্লা, কালাম মোল্লা ও সেলিম মোল্লার বাড়ি ভাঙচুর করে এলাকার লোকজন। এর মধ্যে আলম মোল্লার বাড়ি পুরো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার সকালে এ চারটি বাড়িতে কাউকেই পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় লোকজন বলছেন, এই ব্যক্তিদের বাড়ির মধ্যে একটি বেলগাছে বেঁধে রিপন শেখ নামের ওই ব্যক্তিকে মারধর করা হচ্ছিল। তারপর তাঁকে উদ্ধার করতে এলে ওই বাড়ির সামনেই অন্যদের ওপর হামলা হয়। ঘটনাটি প্রায় মধ্যরাতে হওয়ায় এলাকার লোকজন কম টের পেয়েছে। স্থানীয় লোকজন জানান, দুটি পরিবারের মধ্যে পাঁচ বছর আগে একবার বিরোধ হয়। সে ঘটনায় একটি মামলাও হয়েছিল।
জানতে চাইলে মাগুরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আইয়ুব আলী দুপুরে প্রথম আলোকে বলেন, এখানে গ্রাম্য বা রাজনৈতিক দলাদলির কারণে মারামারি হয়নি। একদম তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি। তবে তদন্তে নেমেছে পুলিশ। আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।