ভৈরব নদের তীরে শতর্বর্ষী পৌষসংক্রান্তির মেলা

নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটী গ্রামে ভৈরব নদের তীরে পৌষসংক্রান্তির মেলা। গতকাল মঙ্গলবার তোলা

ভৈরব নদের তীরে একটি ন্যাড়া বটগাছ। এর চারপাশজুড়ে বসেছে পৌষসংক্রান্তির মেলা। নড়াইল সদর উপজেলার শেখহাটী গ্রামে গতকাল মঙ্গলবার দিনব্যাপী পৌষসংক্রান্তির মেলা অনুষ্ঠিত হয়। নানা ধরনের উপকরণ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কয়েক শ বিক্রেতা। ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় ছিল মানুষের ঢল।

পৌষসংক্রান্তির এ গ্রামীণ মেলা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘আফরার মেলা’ নামেও পরিচিত। মেলাটি বসছে ১০৮ বছর ধরে। আশপাশের নানা জায়গা থেকে মেলায় ভিড় করেন কয়েক হাজার মানুষ।

মেলা উপলক্ষে শখের হাঁড়ি, মাটির সরা, ফুল, শোলার ফুল, মাটির পুতুল, কাঠের একতারা, বাঁশের বাঁশি, বাঁশ ও বেতের সামগ্রী, লোহার দা, বটি, কাঁচি, শিশুদের নানা রকম খেলনা, মোয়া, মুড়কি, বাতাসা বা মিষ্টির বেচাকেনা জমজমাট হয়ে ওঠে। আরও ছিল গ্রামীণ ঐতিহ্যের নাগরদোলা। হাতে ঘোরানো এই নাগরদোলায় চড়ে বড়রাও ফিরে গেছেন যেন শৈশবে।

মেলায় বেতের তৈরি ধামা, দাঁড়িপাল্লা ও লক্ষ্মীর ডালা নিয়ে আসেন যশোরের কেশবপুর উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের রবিন দাস (৫৬)। তিনি বলেন, ‘৪০ বছর ধরে এই মেলায় বেতের তৈরি বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করছি। এবার মেলায় লোকসমাগম কিছুটা কম। তারপরও আজ বিকাল পর্যন্ত সাতটি ধামা বিক্রি করেছি।’

অভয়নগর উপজেলার ভূগিলহাট গ্রামের নিতাই দাস (৬২) দুই বছর ধরে মেলায় নিজের তৈরি খেলনা ঢোল বিক্রি করছেন। তিনি বলেন, ‘এবার মেলায় লোকসমাগম কিছুটা কম। তবে বেচাকেনা একেবারে খারাপ নয়। বেশ কয়েকটি ঢোল বিক্রি করেছি।’

পৌষসংক্রান্তির এ গ্রামীণ মেলা স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে ‘আফরার মেলা’ নামেও পরিচিত। মেলাটি বসছে ১০৮ বছর ধরে। মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ গাব, ডাব, বাতাসা, লবণ, মুরগি ও ছাগল মানত করেন।

গতকাল বিকেলে বিকেলে মেলায় গিয়ে দেখা যায়, পশ্চিম দিক থেকে আসা ভৈরব নদ আমচকা বাঁক নিয়েছে। এই বাঁক থেকে নদ দুই ভাগে ভাগ হয়ে একটি শাখা সোজা দক্ষিণে এবং অপর শাখা কিছুটা উত্তরে যেয়ে পূর্বমুখী হয়েছে। নদের পশ্চিম-দক্ষিণ পাড়ে যশোর সদর উপজেলা আর পূর্ব-পশ্চিম পাড়ে নড়াইল সদর উপজেলা। এই ত্রিমোহিনীতে নদের তীরে একটি বটগাছ। বটগাছের চারপাশে অনেকটা জায়গাজুড়ে বসেছে মেলা। মেলায় পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন দূরদূরান্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীরা। মিষ্টি, খেলনা, চুড়ি, ফিতা, আলতা থেকে শুরু করে ঘরগৃহস্থালির নানা জিনিস বিক্রি হচ্ছে এখানে। মিষ্টি বানানো হচ্ছে ২০টির বেশি দোকানে। বিক্রিও হচ্ছে বেশ। সকাল থেকেই চলছে নাগরদোলা। চলবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। শিশু-কিশোরেরা চড়ছে নাগরদোলায়।

আয়োজকেরা জানান, মাত্র এক দিন মেলা হয়। এদিন ভোর থেকে পুণ্যার্থীরা ভৈরব নদে স্নান করেন। অনেক মানুষ গাব, ডাব, বাতাসা, লবণ, মুরগি ও ছাগল মানত করেন। মেলার দিন তাঁরা মানত শোধ করতে আসেন। তাঁরা যা যা মানত করেন, তা ভৈরব নদের জলে ভাসিয়ে দেন। তাঁরা জানান, সকাল থেকে মেলা শুরু হয়। চলে রাত পর্যন্ত। তবে দুপুরের পর মেলায় লোকসমাগম বাড়তে থাকে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এই মেলায় আসেন।

নড়াইল সদর উপজেলার গুয়াখোলা গ্রামের গৃহবধূ শিলা ‍বিশ্বাস (৩৫) বলেন, ‘দুপুরে মেলায় এসেছি। মেলায় এসে খুব ভালো লাগছে। মেলা থেকে ঘুরে ঘুরে পরিবারের জন্য কিছু জিনিসপত্র কিনেছি।’

নড়াইল সদর উপজেলার তপনভাগ গ্রামের জাকির হোসেন (৪৫) বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে এই মেলায় আসি। মেলা ঘুরে দেখছি আর পছন্দের খাবার কিনে খাচ্ছি। মেলায় সব ধর্মের মানুষ আসেন। বেশি আসেন নারীরা।’

মেলার অন্যতম আকর্ষণ নাগরদোলা। ছোটদের পাশাপাশি বড়রাও এতে চড়েছেন
ছবি: প্রথম আলো

মেলার আয়োজক কমিটির সভাপতি অরুণ সাহা বলেন, ‘মেলাটি পৌষসংক্রান্তির মেলা। মেলাটি ‘আফরার মেলা’ নামেও পরিচিত। শেখহাটী গ্রামে ভুবনেশ্বরী মায়ের শতবর্ষী মন্দির রয়েছে। ১০৮ বছর আগে মকরসংক্রান্তিতে সেই মন্দিরের পুরোহিত স্বপ্নে দেখলেন, ভুবনেশ্বরী মা তাঁকে আদেশ করছেন পাশের গঙ্গা থেকে জল এসে তাঁকে (ভুবনেশ্বরী মা) স্নান করাতে। সেখান থেকে এই দিন গঙ্গাস্নান অনুষ্ঠিত হয়। মেলাও শুরু সেই থেকে। মেলায় মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ গাব, ডাব, বাতাসা, লবণ, মুরগি ও ছাগল মানত করেন। মেলার দিন তাঁরা মানত শোধ করতে আসনে। তাঁরা যা যা মানত করেন, তা নদের জলে ভাসিয়ে দেন।’

মেলার আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং যশোর সদর উপজেলার সিঙ্গিয়া আদর্শ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক সুজিত বিশ্বাস বলেন, ‘১০৮ বছর ধরে একই দিনে মেলাটি বসছে। আশপাশের গ্রাম ছাড়াও দূরদূরান্ত থেকে মানুষ মেলায় আসেন। মেলাটি ঘিরে এলাকার ঘরে ঘরে উৎসবের পরিবেশ বিরাজ করে।’