সুন্দরবনের কোন ফুলের মধুর কত দাম

ভ্রাম্যমাণ দোকানে বোতলভর্তি বিভিন্ন ফুলের মধু সাজিয়ে রেখে বিক্রি করা হয়। খুলনা নগরের কে ডি ঘোষ রোডের পাস থেকে তোলাছবি: ইমতিয়াজ উদ্দীন

খুলনা নগরের কে ডি ঘোষ রোডের পাশে ভ্রাম্যমাণ একটি দোকানে বোতলভর্তি খলিশা, গরান, লিচু ও কালিজিরা ফুলের মধু সাজিয়ে রাখা। দোকানের মালিক মধু বিক্রেতা মাহবুবুর রহমান দাবি করলেন, তাঁর দোকানে সব কটিই একেবারে খাঁটি মধু, কোনো ভেজাল নেই। সুন্দরবন থেকে তাঁর নিজস্ব মৌয়ালদের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছেন খলিশা আর গরানের মধু। লিচু আর কালিজিরার মধু নিয়েছেন অন্য জায়গা থেকে।

মাহবুবুর রহমান বলেন, গত বছরগুলোর তুলনায় এবার মধুর দাম একটু বেশি। তাঁর দোকানে কেজিপ্রতি খলিশার মধু ১ হাজার ১০০ টাকা, গরানের মধু ১ হাজার টাকা, কালিজিরার মধু ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং লিচু ফুলের মধু ৭০০ টাকা।

মাহবুবুরের কথার সূত্র ধরে মধুর পাইকারি ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতা ও সুন্দরবনে যাওয়া মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুন্দরবনে এখন মধু আহরণ মৌসুম চলছে। বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ১ এপ্রিল শুরু হওয়া সুন্দরবনে মধু আহরণ চলবে আগামী ৩১ মে পর্যন্ত। তবে মধুর দাম এবার গত বছরের তুলনায় কিছুটা বেশি। আবার একেকজন মধু বিক্রেতা একেক দামে বিক্রি করছেন। তবে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া মৌয়াল আর মৌয়ালদের মহাজনদের কাছ থেকে কিছুটা কম দামে মধু কেনা যাচ্ছে।

মৌয়ালদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মৌসুমের শুরুতে সুন্দরবনে খলিশা ও গরান ফুলের মধু আসে। এরপর আসে কেওড়া ফুলের মধু। তারপর বাইন আর নানান মিশ্র ফুলের মধু। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি হচ্ছে খলিশার মধু। চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে বাজারে খলিশা আর গরান ফুলের মধু আসতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন

আজ শনিবার সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর তীরে কামরুল ইসলাম নামের এক মৌয়াল বললেন, টানা ১৪ দিন সুন্দরবনে ঘুরে মধু পেয়েছেন ৮ মণ (৪০ কেজিতে ১ মণ)। এই মধুতে খলিশা আর গরান ফুলের মিশেল আছে। প্রতি মণ মধু ২৫ হাজার টাকায় পাইকারি দরে বিক্রি হবে।

আরেক মৌয়াল কামরুল ইসলাম বলেন, দু–এক দিনের মধ্যে আবারও সুন্দরবনে ঢুকবেন। তখন কেওড়া ফুলের মধু আনবেন। এ বছর কেওড়ার মধু ২৩ থেকে ২৪ হাজার টাকার মতো প্রতি মণ বিক্রি হবে। মৌসুমের শেষ দিকে যখন বাইন ফুলের মধু হয়, তখন একেকটি মৌচাকে ১৪ থেকে ১৫ কেজি মধু হয়। তবে ওই মধুর দাম কম। গত বছর বাইনের মধু মণপ্রতি ১৪ থেকে ১৬ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবারও তেমনটাই হবে।

সম্প্রতি সুন্দরবন থেকে মধু সংগ্রহ করে লোকালয়ে ফিরছেন কয়রার মদিনাবাদ গ্রামের মৌয়াল আবুল কালাম। তিনি বলেন, প্রথমবার যে মধু কেটে এনেছেন, এটি সবচেয়ে ভালো মধু। মধুর রং কিছুটা সাদা। একেবারে খাঁটি খলিশা ফুলের। এটা খুচরায় কেজিপ্রতি এক হাজার টাকা করে রাখা হচ্ছে। আর যে মধুটা কিছুটা লালচে ধরনের, সেটি গরান ফুলের। সেটি খুচরা বিক্রি করেন ৯০০ টাকায়।

গহিন সুন্দরবনে মৌমাছির চাকের নিচে ধোঁয়া ধরতেই মৌমাছিরা সরতে শুরু করে। এরপর চাক কেটে মধু সংগ্রহ করা হয়। খুলনার কয়রা উপজেলার মুচির খাল এলাকায়
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

তবে খুচরায় এবার ১ হাজার ২০০ টাকার কমে মধুর কেজি বিক্রি হচ্ছে না বলে জানান কয়রা বাজারের মধু বিক্রেতা বিকাশ চন্দ্র মণ্ডল। তিনি কয়রা উপজেলা সদরের থানা রোর্ডের পাশে একটি মুঠোফোন রিচার্জের দোকানে কয়েক বছর ধরে মধুও বিক্রি করছেন। বিকাশ চন্দ্র বলেন, ‘দাম বেশি হওয়ায় এবার বিক্রি কম। আমি নিজে মৌয়ালদের কাছ থেকে ৯০০ টাকা কেজি দরে মধু কিনেছি। এখন ১ হাজার ২০০ টাকার নিচে আর বিক্রি করব না।’

সুন্দরবনসংলগ্ন কয়রা উপজেলার আরেক খুচরা মধু বিক্রেতা মনিরুজ্জামান বলেন, সুন্দরবনের মধুর স্বাদ, রং ও গন্ধ অতুলনীয়। এর চাহিদা আছে দেশজুড়ে। সুন্দরবন থেকে খলিশা আর গরান ফুলের মধু সংগ্রহ এখন শেষ। এবার কেওড়া ফুলের মধু হবে। তাঁরা খুচরা বাজারে খলিশা আর গরানের মধু ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি করছেন।

এ বছর সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল। প্রসঙ্গত, ১ কুইন্টাল সমান ১০০ কেজি।

সুন্দরবনের মধুর পাইকারি বিক্রেতা কয়রা উপজেলার রফিকুল ইসলাম বলেন, এ বছর প্রথম ধাপের খলিশা আর গরানের মধু প্রতি মণ ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করছেন। গত বছরের তুলনায় দাম প্রতি মণে এক হাজার টাকা বেশি। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কেওড়া ফুলের মধু চলে আসবে, তার দাম মণপ্রতি ২৪ হাজার টাকা। গত বছর এই পরিমাণ মধুর দাম ছিল ২২ হাজার টাকা মণ। বাইন আর নানান মিশ্র ফুলের মধুর দাম পড়বে মণপ্রতি ১৮ হাজার টাকা। তবে বাইন ফুলের মধু মানুষ কিনতে চান না।

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে সুন্দরবন থেকে ৪ হাজার ৪৬৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮ কুইন্টালে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরও কমে হয় ২ হাজার ৮২৫ কুইন্টাল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কিছুটা বেড়ে ৩ হাজার ১৮৩ কুইন্টাল মধু আহরণ করা হয়েছিল। এ বছর সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জের আওতাধীন এলাকায় মধু আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ হাজার ৫০০ কুইন্টাল। প্রসঙ্গত, ১ কুইন্টাল সমান ১০০ কেজি।

সুন্দরবন থেকে মধু নিয়ে লোকালয়ে ফিরছেন মৌয়ালরা। এভাবে প্লাস্টিকের ড্রামে করে সুন্দরবনের মধু আনা হয়। শনিবার সুন্দরবন সংলগ্ন কয়রা উপজেলার শাকবাড়িয়া নদীর তীরে
ছবি: প্রথম আলো

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, গত বছর মধু আহরণ থেকে ৫০ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছিল। এবার পশ্চিম সুন্দরবনের খুলনা ও সাতক্ষীরা থেকে ৪ হাজার ৪৬০ জন মৌয়াল ৬৭৫টি নৌকা নিয়ে মধু আহরণে সুন্দরবনে ঢোকার অনুমতি নিয়েছেন।