তিন ভূঁইয়ার কোন্দলে জর্জরিত নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপি

আবদুল গফুর ভূঁইয়া ও মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়াছবি: সংগৃহীত

দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গ্রুপিং আর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়ে পড়েছে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপি। দলীয় প্রভাব বিস্তার করতে প্রায়ই সংঘাতে জড়াচ্ছেন বিএনপির নেতা-কর্মীরা। এক পক্ষ কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করলে আরেক পক্ষ পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করছে। এই দলাদলি ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সর্বশেষ পরিণতি স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে হত্যা।

বিএনপির একটি পক্ষের হামলায় অপর পক্ষের অনুসারী স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা সেলিম ভূঁইয়া (৪৫) নিহত হন। তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে বিএনপির এক পক্ষের অভিযোগ। গত শনিবার বেলা আড়াইটার দিকে উপজেলার বাঙ্গড্ডা বাজার এলাকায় ওই ঘটনা ঘটে। নিহত সেলিম ভূঁইয়া উপজেলার হেসাখাল ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক ছিলেন।

উপজেলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ভাষ্য, ভূঁইয়াদের গ্রুপিং আর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত নাঙ্গলকোট বিএনপি। বর্তমানে তিন ভূঁইয়ার তিনটি পক্ষ নাঙ্গলকোটে পৃথকভাবে দলীয় কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে পুরোনো দলাদলি ও দ্বন্দ্ব চলছে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়ার সঙ্গে উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার। এ ছাড়া কয়েক বছর ধরে নাঙ্গলকোটে বিএনপির রাজনীতিতে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজির আহম্মেদ ভূঁইয়াও সক্রিয়। শনিবার হামলায় স্বেচ্ছাসেবক দলের নিহত নেতা সেলিম ভূঁইয়া সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল গফুর ভূঁইয়ার অনুসারী। আর হামলা চালানোর অভিযোগ উঠেছে মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

গফুর ভূঁইয়া ও মোবাশ্বের ভূঁইয়া কুমিল্লা-১০ (নাঙ্গলকোট, লালমাই ও কুমিল্লা সদর দক্ষিণ) আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী। ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুই ভূঁইয়াকে বাদ দিয়ে এ আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পান বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী। নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজির আহম্মেদ ভূঁইয়া বর্তমানে মনিরুল হক চৌধুরীর বলয়ে রাজনীতি করছেন। তবে নাঙ্গলকোট বিএনপির রাজনীতিতে এখন মূল আলোচনা গফুর ভূঁইয়া আর মোবাশ্বের ভূঁইয়াকে নিয়েই।

দলীয় সূত্র জানিয়েছে, বিএনপি নেতা এ কে এম কামরুজ্জামান ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ১৯৯৮ সালে নাঙ্গলকোট বিএনপির হাল ধরেন আবদুল গফুর ভূঁইয়া। ২০০১ সালে বিলুপ্ত হওয়া কুমিল্লা-১১ (নাঙ্গলকোট) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন গফুর। ১/১১-এর সময় একটি হত্যা মামলায় জেলে যান তৎকালীন উপজেলা বিএনপির সভাপতি আবদুল গফুর ভূঁইয়া। ওই সময় উপজেলা বিএনপির সহসভাপতির পদে থাকা মোবাশ্বের বিএনপির রাজনীতিতে পৃথক একটি পক্ষ তৈরি করেন। সেই থেকে নাঙ্গলকোটে বিএনপির রাজনীতিতে ফাটল দেখা দেয়। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রথমে গফুর ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দেয় বিএনপি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গফুরের মনোনয়ন বাগিয়ে নেন মোবাশ্বের ভূঁইয়া। তবে ওই নির্বাচনে মোবাশ্বের আওয়ামী লীগের প্রার্থী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে পরাজিত হন। এরপরই শুরু হয় দুই ভূঁইয়ার জোরালো গ্রুপিং। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর মোবাশ্বেরকে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়, ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়কের পদ থেকে ২০১৯ সালে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নেন মোবাশ্বের। পরে ২০২২ সালে নজির আহমেদ ভূঁইয়া আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দল চাঙা হয়ে ওঠে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, কোথাও এক পক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করলে আরেক পক্ষও একই স্থানে কর্মসূচি ঘোষণা করছে। এ ছাড়া প্রায়ই সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন ভূঁইয়াদের অনুসারী বিএনপির নেতা-কর্মীরা।

সর্বশেষ গত শনিবার বিকেলে উপজেলার বাঙ্গড্ডা স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে মোবাশ্বের আলমের অনুসারী যুবদলের কর্মিসভা ছিল। সভাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গড্ডা বাজার এলাকায় তাঁদের নেতা-কর্মীরা সংগঠিত ছিলেন। একই সময়ে গফুর ভূঁইয়ার একটি মতবিনিময় সভা ছিল উপজেলার কাকৈরতলা এলাকায়। দুপুরে গফুর ও তাঁর অনুসারীরা উপজেলার রায়কোট দক্ষিণ ইউনিয়নে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে ছিলেন। সেখান থেকে মোটরসাইকেলে করে কাকৈরতলা যাওয়ার সময় মোবাশ্বের আলমের পক্ষের কয়েকজন বাঙ্গড্ডা বাজার এলাকায় গফুরের কয়েকজন অনুসারীর ওপর হামলা চালান। এতে দুই পক্ষের নেতাদের মধ্যে মারামারি হয়। এ সময় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা সেলিম ভূঁইয়াকে ব্যাপক পেটানো হয়। তিনি গুরুতর আহত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

আবদুল গফুর ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাঙ্গলকোটের মানুষ বিএনপি বলতে গফুর ভূঁইয়াকে চেনে। এখানে মোবাশ্বের ও নজিরের কোনো অস্তিত্ব নেই। তাঁদের সঙ্গে বিএনপির এক ভাগ নেতা-কর্মীও নেই। এ জন্য ৫ আগস্টের পর মোবাশ্বের যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ক্যাডারদের নিজের সঙ্গে নিয়ে ঘুরছেন। বাঙ্গড্ডায় মোবাশ্বেরের উপস্থিতিতে আমাদের স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা সেলিম ভূঁইয়াকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা হত্যার বিচার চাই।’

তবে হত্যার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন উপজেলা বিএনপির সাবেক আহ্বায়ক মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ও গফুর ভূঁইয়ার একই সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত ছিল। তিনি খেয়ে বের হয়েছেন, এমন সময় আমরা সেখানে প্রবেশ করেছি। বাঙ্গড্ডায় কী হয়েছে, আমি জানিও না। আমার কোনো নেতা-কর্মী এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত নেই। তিনি (সেলিম) দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, নাকি চাঁদাবাজি করতে গিয়ে মারা গেছেন—এমন কথাও শোনা যাচ্ছে। তবে যদি কেউ তাঁকে হত্যা করে থাকে, আমরাও হত্যার বিচার চাই। পুলিশ পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখুক।’

দলাদলি প্রসঙ্গে মোবাশ্বের আলম বলেন, ‘গ্রুপিং বলব না, আমি মনে করি, এটা নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা। গফুর ভূঁইয়াও মনোনয়ন চায়, আমিও চাই, আবার মনির চৌধুরীও চায়। বিএনপি বড় দল, প্রতিযোগিতা থাকা স্বাভাবিক।’

নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক নজির আহম্মেদ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘গফুর ভূঁইয়া এখন বিএনপির কেউ নন, তিনি সাবেক হয়ে গেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন তিনি। আমি দীর্ঘদিন ধরে নাঙ্গলকোটে বিএনপিকে সুসংগঠিত করার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। নাঙ্গলকোটে বিএনপির অন্য কোনো গ্রুপ নেই।’

জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির কুমিল্লা বিভাগীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাক মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘নাঙ্গলকোট উপজেলা বিএনপিতে দীর্ঘদিন ধরে কোন্দল আছে। আমরা চেষ্টা করেছি কোন্দল নিরসন করতে। আর শনিবারের হত্যার বিষয়টি আমরা জেনেছি। এ বিষয়ে বিস্তারিত কেন্দ্রীয় নেতাদের জানানো হয়েছে। এ ছাড়া আমরা ঘটনাটি খতিয়ে দেখছি। যাঁরা এ ঘটনায় জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’