পাহাড়, নদী ও লেকের অপার সৌন্দর্য নিয়ে অপেক্ষায় টাঙ্গুয়ার হাওর
টাঙ্গুয়ার হাওর সৌন্দর্যে অনন্য এক জলাভূমি। পর্যটকদের কাছে অতিপ্রিয়। ভরা বর্ষায় সেই রূপ উপচে পড়ে। হাওরের স্বচ্ছ জলে জলকেলি, রাতে জল-জোছনার মায়াবী খেলায় তনু–মন দুটোই জুড়িয়ে যায়। শেষ বিকেলে উত্তরের সবুজ মেঘালয় পাহাড়, আকাশে থাকা মেঘের ছায়া অন্য রকম এক মায়ায় বিলিয়ে দেয়, মুগ্ধতা ছড়ায় চারপাশে।
হাওর, পাহাড়, নদী ও লেকের অপার সৌন্দর্য একসঙ্গে ধরা দেয় সুনামগঞ্জে। টাঙ্গুয়ার হাওর ও আশপাশের এলাকা ঘুরে তাই মুগ্ধতা নিয়ে ফেরেন পর্যটকেরা। ঈদের লম্বা ছুটি এবার। তাই টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটকদের ঢল নামবে। টাঙ্গুয়ার হাওরে এলে পর্যটকেরা বাড়তি হিসেবে জাদুকাটা নদী, বারিক টিলা, শহীদ সিরাজ লেক (নীলাদ্রি লেক), শিমুলবাগান ও লাকমাছড়া ঘুরে যান। পুরো এলাকা কাছাকাছি, ছবির মতো সুন্দর।
হাওর পর্যটনে গত পাঁচ বছরে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে হাউসবোট। আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ টাঙ্গুয়ার হাওরে নিবন্ধিত প্রায় এক শ হাউসবোট আছে। এর বাইরে নানা জায়গা থেকে ছোট-বড় আরও শ খানেক নৌকা ও বোট আসে টাঙ্গুয়ার হাওরে। পর্যটকেরা এসব বোটে সারা দিন হাওরে ঘুরে বেড়ান, পরে বোটেই রাত যাপন করেন হাওরের টেকেরঘাট এলাকায়। আবার অনেক বোট সারা দিন ঘুরে পর্যটকদের নিয়ে হাওরে থেকে ফিরে আসে।
হাউসবোট পরিচালনায় যুক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব বোটে প্যাকেজ হিসেবে হাওরে পর্যটকদের নেওয়া হয়। অনলাইনে অনেকেই প্রচার করেন। হাওরে মূলত দুই দিনের প্যাকেজ হয়। সকালে পর্যটকেরা বোটে উঠবেন, সারা দিন হাওরে ঘুরবেন। বোটগুলো প্রথমে যায় হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ার এলাকায়। এখানে পর্যটকেরা ছোট ছোট নৌকায় ঘুরে বেড়ান করচগাছের বাগানের ভেতর। অনেকেই জলকেলি করেন। এখানে দুপুরের খাবার সেরে বোটগুলো রওনা হয় হাওরের উত্তরপাড়ে মেঘালয় পাহাড়ে পাদদেশে থাকা টেকেরঘাট এলাকায়। টেকেরঘাট এলাকায় বোটেই রাত যাপন করেন পর্যটকেরা।
পরদিন আশপাশের এলাকা ঘুরে আবার হাওর থেকে ফিরে আসেন। অনেক বোট সুনামগঞ্জ পৌর শহরের সুরমা নদীর বিভিন্ন ঘাট থেকে যায়। আবার কিছু যায় তাহিরপুর উপজেলার আনোয়ারপুর এবং উপজেলা সদর থেকে। শহর থেকে যেগুলো ছাড়ে, সেখানে পর্যটকেরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে বোটে ওঠেন। অন্যরা তাহিরপুর গিয়ে তারপর যান।
প্যাকেজ ছাড়াও অনেকেই পুরো বোট ভাড়া নিয়ে থাকেন। আবার কেউ কেউ এক দিনের জন্য নৌকা বা বোট ভাড়া করেন। বিলাসবহুল বোটগুলোয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, জেনারেটরসহ আধুনিক সব সুযোগ–সুবিধা আছে। পর্যটকেরা বোটে খাওয়াদাওয়া করেন।
হাওরে এখন পুরো বর্ষা। জলে টইটুম্বুর হাওর। ১৫ দিন ধরেই হাওরে পর্যটক আসা শুরু করেছেন। দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। এলাকার নৌকাগুলোর মালিক-শ্রমিকেরাও ব্যস্ত সময় পার করছেন। হাওরের পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের পাশে গোলাবাড়ি গ্রামে পর্যটকদের থাকার জন্য ‘হাওর বিলাস’ নামে একটি গেস্টহাউস আছে খসরু মিয়ার। বছর দশেক আগে তিনি টিনশেডের আধাপাকা একটি ঘরে এটি করেছেন। এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাঁর নিজের একটি নৌকাও আছে। তবে বিলাসবহুল হাউসবোট আসায় তাঁদের ব্যবসা কিছুটা কমেছে। খসরু মিয়া বলেন, ‘এবার ঈদে ছুটি লম্বা। তাই মানুষ বেশি আইব। সব নৌকা ভাড়া হয়ে গেছে। হাওরের পরিবেশও ভালা। আমরা পর্যটকদের অপেক্ষায় আছি।’
টাঙ্গুয়ার হাওরে হাউসবোট ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আরাফাত আকন্দ জানান, সব হাউসবোট বুকিং হয়ে গেছে। কোনোটি পুরোটা, আবার কোনোটি প্যাকেজে। এখনো অনেক পর্যটকের চাপ আছে।
তাহিরপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আবুল হাসেম বলেন, প্রতিটি পর্যটকবাহী নৌযানকে উপজেলা প্রশাসনের কাছে নিবন্ধন করে হাওরে যেতে হবে। হাওরের প্রকৃতি-পরিবেশের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। পানিদূষণ হয়, এমন কোনো বর্জ্য ফেলা যাবে না। পর্যটকদের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় এই হাওরের অবস্থান। এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট–বড় ১০৯টি বিল আছে। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর অনেকটা সমুদ্রের রূপ নেয়। হাওর এলাকার ৮৮টি গ্রাম আছে। বর্ষায় এই গ্রামগুলোকে ছোট ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়। হাওরের উত্তরে ভারতের মেঘালয় পাহাড়। এই পাহাড় থেকে ৩৮টি ঝরনা নেমে এসে মিশেছে টাঙ্গুয়ার হাওরে।