মাঠে সক্রিয় বিএনপি ও জামায়াত, এনসিপিও আছে আলোচনায়

কুমিল্লার রাজনীতিতে কিছুদিন আগেও শুধুই আওয়ামী লীগের দাপট ছিল। বিএনপির জন্য রাজনীতির মাঠটা ছিল একেবারেই কোণঠাসা। জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি চলেছে অনেকটা আত্মগোপনে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই এখন আত্মগোপনে। এমন পরিস্থিতিতে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জেলার প্রতিটি আসনে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দলের মনোনীত প্রার্থী ও নেতা–কর্মীরা মাঠে নেমেছেন। প্রতিদিন নানা কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলও ছেয়ে গেছে প্রার্থীদের ব্যানার, ফেস্টুন আর পোস্টারে।

১৭টি উপজেলা ও ১৮টি থানা নিয়ে দেশের অন্যতম বৃহৎ জেলা কুমিল্লায় সংসদীয় আসন ১১টি। এর মধ্যে জেলার উত্তর অংশে রয়েছে ৫টি সংসদীয় আসন। বেশির ভাগ দল এই অংশে ‘কুমিল্লা উত্তর’ সাংগঠনিক জেলা হিসেবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে।

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) আনুষ্ঠানিক প্রার্থী ঘোষণা না করলেও কুমিল্লা-৪ আসনে দলটির অন্যতম শীর্ষ নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ তৎপর আছেন। জেলার একটি আসনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) শক্ত অবস্থান রয়েছে। বামপন্থী দলগুলোর তেমন তৎপরতা না থাকলেও ইসলামপন্থী বেশ কয়েকটি দলের নেতারা মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। এ ছাড়া জেলায় জাতীয় পার্টির (জাপা) কার্যক্রম নেই বললেই চলে। মাঠে অনেক দল থাকলেও মূল আলোচনা বিএনপি আর জামায়াতকে ঘিরেই।

বিএনপি সম্প্রতি সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করলেও কুমিল্লায় প্রার্থী নির্বাচনপ্রক্রিয়া অন্তত আট মাস আগেই শেষ করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি বাছাইপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করায় প্রার্থীরা এখন গণসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। জামায়াতের তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও ছুটছেন মানুষের কাছে। এরই মধ্যে প্রতিটি আসনে নির্বাচনী কেন্দ্র কমিটিও শেষ করেছে দলটি।

কুমিল্লা-১ (দাউদকান্দি ও মেঘনা) আসন

কুমিল্লা-১ আসনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ওপর আস্থা রেখেছে বিএনপি। চারবারের সংসদ সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের হাত ধরে আগামী নির্বাচনে আসনটি পুনরুদ্ধার করতে চায় বিএনপি। সর্বশেষ ২০০১ সালে এখানে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মোশাররফ হোসেন জয়ী হয়েছিলেন।

স্থানীয় নেতা–কর্মীরা বলছেন, বিএনপির এই জ্যেষ্ঠ নেতা কিছুটা অসুস্থ ও বয়সের কারণে এলাকায় নিয়মিত সময় দিতে পারছেন না। তবে বাবার হয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক দায়িত্ব সামলাচ্ছেন তাঁর ছেলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য খন্দকার মারুফ হোসেন।

এ প্রসঙ্গে খন্দকার মারুফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের আসনে বিএনপিতে কোনো গ্রুপিং নেই, সবাই দলীয় প্রার্থীর পক্ষে ঐক্যবদ্ধ। বিএনপি খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ওপর আস্থা রাখায় দলের নেতা–কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও বেশ আনন্দিত।’

প্রতিটি আসনেই এনসিপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা আশা করছি আগামী নির্বাচনে কুমিল্লার ১১টি আসনেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করতে পারব এবং বিজয়ী হব।
নাভিদ নওরোজ শাহ্ , এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও কুমিল্লা অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক

জামায়াতে ইসলামী দলের দাউদকান্দি উপজেলা শাখার আমির মনিরুজ্জামান বাহলুলকে এখানে প্রার্থী করেছে। তিনি বর্তমানে মাঠে বেশ সরব। নিয়মিত দলের কর্মসূচির পাশাপাশি মানুষের কাছে ছুটছেন ভোটের পাল্লা ভারী করার জন্য। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আশরাফুল আলমসহ অন্যান্য কয়েকটি দলও মাঠে রয়েছে।

কুমিল্লা-২ (হোমনা ও তিতাস) আসন

কুমিল্লা-২ আসনে এখনো প্রার্থী ঘোষণা করেনি বিএনপি। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপিতে অসন্তোষ রয়েছে। পাশাপাশি দলের একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশীর মধ্যে কোন্দলও বেশ চাঙা হচ্ছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালের নির্বাচনে আসনটিতে জয় পেয়েছিল বিএনপি।
বিএনপির একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও মাঠে আলোচনায় দলের সাংগঠনিক সম্পাদক (কুমিল্লা বিভাগ) মো. সেলিম ভূঁইয়া, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার এক সময়ের এপিএস-টু মো. আবদুল মতিন খান এবং হোমনা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আজিজুর রহমান মোল্লা।

আরও পড়ুন

সেলিম ভূঁইয়া চষে বেড়াচ্ছেন হোমনা ও তিতাসের নির্বাচনী মাঠ। আবদুল মতিনও মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে এলাকায় সভা-সমাবেশ করছেন। এ ছাড়া প্রয়াত এম কে আনোয়ারের ছেলে মাহমুদ আনোয়ারের (কাইজার) নাম আলোচনায় থাকলেও মাঠে তৎপরতা নেই।

মো. সেলিম ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি প্রতিটি এলাকায় সভা-সমাবেশে নিয়মিত যোগদান করছি, সব স্থানেই মানুষের ব্যাপক সাড়া পাচ্ছি। এ ছাড়া এই আসনটি বিএনপির আসন হিসেবেই পরিচিত। সাধারণ মানুষও বিএনপির আসনটি বিএনপিকে ফিরিয়ে দিতে চায়।’

দলের কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার সদস্য ও ঢাকার মহানগর উত্তরের সহকারী সেক্রেটারি নাজিম উদ্দিন মোল্লাকে এই আসনে প্রার্থী করেছে জামায়াত। নাজিম উদ্দিন চষে বেড়াচ্ছেন দুই উপজেলা; তাঁর পক্ষে সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও বেশ সক্রিয়। ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন মাওলানা তাজুল ইসলাম।

কুমিল্লা-৩ (মুরাদনগর) আসন

স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার কারণে বেশ আলোচনায় আসে কুমিল্লা-৩ আসন। তিনি এই আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। রাজনৈতিক কারণে বিএনপি নেতা-কর্মী ও আসিফ মাহমুদের অনুসারীরা পাল্টাপাল্টি বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করেন। তবে সম্প্রতি আসিফ মাহমুদ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন তিনি ঢাকার কোনো আসন থেকে নির্বাচন করতে চান।

আরও পড়ুন

বিএনপি এখানে দলের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদকে প্রার্থী করেছে। কায়কোবাদ এখন পর্যন্ত ছয়বার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে পাঁচবার বিজয়ী হয়েছেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। বর্তমানে কুমিল্লা-৩ আসনে কায়কোবাদের সঙ্গে ভোটের মাঠে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই বলে মনে করেন নেতা–কর্মীরা।

চান্দিনায় শক্ত অবস্থান রয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি)। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, জোটসঙ্গী এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদের জন্যই আসনটিতে এখনো প্রার্থী দেয়নি বিএনপি।

এখানে জামায়াতের প্রার্থী ইউসুফ হাকিম সোহেল মুরাদনগর উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান। উত্তর জেলা জামায়াতের কর্মপরিষদের এই সদস্য এখন মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। নিয়মিত বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী মাওলানা আহমদ আব্দুল কাইয়ুমও আসনটিতে সক্রিয়।
মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিগত ১৮ বছর জনগণ ভোট দিতে পারেনি। জনগণ এখন ভোট দিয়ে তাদের ভোটাধিকার ফিরে পেতে চায়। এই নির্বাচন যত দ্রুত হবে, ততই দেশের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য ভালো।’

কুমিল্লা-৪ (দেবীদ্বার) আসন

জেলার অন্যান্য আসনের তুলনায় কুমিল্লা-৪ আসনের রাজনীতি নিয়ে বেশি আলোচনা চলছে। এখান থেকে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ নির্বাচন করবেন, বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত। তিনি নিয়মিত এলাকায় সভা-সমাবেশ, উঠান বৈঠকের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হাসনাতের নেতৃত্ব থেকেই দেবীদ্বারে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তিনি এলাকায় নিয়মিত গণসংযোগ করে যাচ্ছেন এনসিপির পক্ষে জনমত গঠনে।

আরও পড়ুন

বিএনপি এখানে প্রার্থী করেছে উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান মুন্সীকে। এই আসন থেকে এখন পর্যন্ত তিনবার নির্বাচন করে তিনবারই বিজয়ী হয়েছেন তিনি। তবে বিএনপির শক্ত অবস্থান থাকলেও এই আসনে দলের মধ্যে অন্তর্কোন্দল ও গ্রুপিংও রয়েছে।

এই আসনে জামায়াতের প্রার্থী কুমিল্লা উত্তর জেলার সেক্রেটারি সাইফুল ইসলাম (শহীদ)। নিজের ভোটের পাল্লা ভারী করতে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন তিনি। ইসলামী আন্দোলন আবদুল করিমকে এই আসনে তাঁদের প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করেছে। এ ছাড়া সিপিবি এবং ন্যাপও এই আসনে বেশ সক্রিয়।

কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসন

জেলার মধ্যে শুধু চান্দিনায় শক্ত অবস্থান রয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি)। স্থানীয় লোকজনের ধারণা, জোটসঙ্গী এলডিপির মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদের জন্যই আসনটিতে এখনো প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। এ নিয়ে স্থানীয় বিএনপিতে দেখা দিয়েছে অসন্তোষ।

রেদোয়ান আহমেদ এই আসনে সর্বশেষ ২০০১ সালে ধানের শীষ প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালেও বিএনপি জোটের প্রার্থী ছিলেন তিনি। ‘হেভিওয়েট প্রার্থী’ হিসেবে তিনি এলাকায় নিয়মিত সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন।

কুমিল্লা-৭ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে রাজনীতির মাঠে আছেন আতিকুল আলম ওরফে শাওন। ২০০৮ সালে তাঁর প্রয়াত বাবা উত্তর জেলা বিএনপির সভাপতি খোরশেদ আলম এই আসনে দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন।

আতিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চান্দিনার নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষ মনেপ্রাণে চায় বিএনপির প্রার্থীকে ধানের শীষে ভোট দিতে। তারা অন্য দলের কাউকে বিএনপির বা ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে দেখতে চায় না।’

এদিকে কুমিল্লা-৭ আসনে জামায়াত তাদের দলীয় প্রার্থী হিসেবে মাওলানা মোশাররফ হোসেনের নাম ঘোষণা করেছে। তিনি এলাকায় গণসংযোগের পাশাপাশি নিয়মিত সভা-সমাবেশ করে যাচ্ছেন। অবশ্য জামায়াতের প্রার্থীকে নিয়ে দলের একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষও দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর চান্দিনায় দলীয় কর্মসূচিতে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।

চান্দিনায় এনসিপির তেমন কোনো তৎপরতা এখনো শুরু হয়নি। এই আসনে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন মুফতি এহতেশামুল হক কাসেমী।
কুমিল্লা উত্তরের প্রতিটি আসনে জামায়াতের অবস্থান অত্যন্ত শক্ত বলে দাবি কুমিল্লা উত্তর জেলা জামায়াতের আমির মো. আবদুল মতিনের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যান্য দল সদ্য প্রার্থী ঘোষণা করলেও আমরা অনেক আগেই দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পেরেছি। যার কারণে আমরা অনেক আগ থেকেই প্রচারণা শুরু করেছি এবং মানুষের কাছে বেশি পৌঁছাতে পেরেছি।’

এনসিপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক ও কুমিল্লা অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক নাভিদ নওরোজ শাহ্ প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুমিল্লার বেশ কয়েকটি আসনে একাধিক প্রার্থী আমাদের মনোনয়নের জন্য আবেদন করেছেন। প্রতিটি আসনেই এনসিপির মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা বাড়ছে। আমরা আশা করছি আগামী নির্বাচনে কুমিল্লার ১১টি আসনেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করতে পারব এবং বিজয়ী হব।’

আরও পড়ুন