ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন মোত্তাকিনা আক্তার ও মাহমুদুল হাসান
ছবি: প্রথম আলো

শৈশব থেকে জীবনের কঠিন ও রূঢ় রূপটিই দেখেছেন তাঁরা। দুজনের ঠিকানা আলাদা, জগৎ আলাদা কিন্তু নির্মম বাস্তবতা দুজনের জীবনকেই ঘায়েল করেছে বারবার। এর মধ্যেও দুজনের একটি অভিন্ন স্বপ্ন—তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা। কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ে সে স্বপ্ন পূরণের পথ তৈরি করেছেন তাঁরা। দুজনই এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু দারিদ্র্যর সঙ্গে আজীবন লড়াই করে বড় হওয়া এই দুজন এখন ভর্তির টাকা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন। বহু চেষ্টা করেও তাঁরা নিজেদের ভর্তির টাকা জোগাতে পারেননি। তাঁদের ভর্তির শেষ দিন ৩১ আগস্ট (বুধবার)।

এই দুই শিক্ষার্থী হলেন মোত্তাকিনা আক্তার ও মাহমুদুল হাসান। মোত্তাকিনার বাড়ি রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার শেখেরহাট সিংগীমারি গ্রামে। আর মাহমুদুলের বাড়ি একই উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের বসরাজপুর মাস্টারপাড়া গ্রামে।

অভাবে দমেননি মোত্তাকিনা

চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় মোত্তাকিনা আক্তারের মা নুরজাহান বেগম মারা যান। চার বোনের মধ্যে মোত্তাকিনা দ্বিতীয়। বড় বোনের বিয়ে হয়েছে আর ছোট দুই বোন পড়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। বাবা আতিয়ার রহমানের টানাপোড়েনের সংসার। বাড়ির পাশে ছোট একটি দোকান আছে তাঁর। দোকানের সামান্য আয় আর দিনমজুরির টাকা দিয়েই অতিকষ্টে চলে সাত সদস্যের সংসার।

অভাবের কারণে মোত্তাকিনার পড়াশোনার খরচ দিতে পারেননি বাবা। তবু দমে যাননি মোত্তাকিনা। শত কষ্টের মধ্যেও লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন তিনি। প্রতিবেশী শিশুদের পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। ২০১৯ সালে এসএসসি ও ২০২১ সালে এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পান মোত্তাকিনা। মাধ্যমিকে ভালো ফলের পর তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পান। কিন্তু টাকার অভাবে সেখানে ভর্তি হতে না পেরে পড়াশোনা করেন বদরগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে। সেখান থেকেই এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি।

মোত্তাকিনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে প্রায় ২০ হাজার টাকা লাগবে। এ ছাড়া থাকা-খাওয়ার টাকা লাগবে। ৩১ আগস্ট ভর্তির শেষ দিন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ভর্তির টাকা জোগাড় করতে পারিনি। সুদে টাকা নেওয়ার জন্য গ্রামে অনেকের কাছে বাবা ধরনা দিয়েছেন। কেউ টাকা দিতে রাজি হননি। এমন অবস্থায় খুব দুশ্চিন্তায় আছি। টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হবে কি না জানি না।’

মোত্তাকিনার বাবা আতিয়ার রহমান বলেন, ‘বেটিতো পড়া ছাড়া বোঝে না। মানুষ নাগে দিছনু অয় বিয়াও করে না। ভরতির টাকার জন্যে কত মানুষের হাতপাও ধরচু। গরিবোক কায়ো টাকা দেয় না। ছইলটা চিন্তাতে শুকি গেইচে। তোরা মোর ছইলটার প্যাকে একনা দ্যাখেন।’

এতিমখানা থেকে ঢাবির পথে মাহমুদুল

মাহমুদুল হাসানের বয়স যখন তিন বছর, তখন তাঁর মা–বাবার বিচ্ছেদ হয়। সংসারে অভাবের কারণে ছোট্ট মাহমুদুলকে বাবা হাফিজুল ইসলাম রেখে আসেন স্থানীয় একটি এতিমখানায়। সেখানেই থাকা, সেখানেই খাওয়া। ছয় বছর বয়সে মাহমুদুলকে ভর্তি করা হয় রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার ময়নাকুড়ি দারুস সুন্নাত আলিম মাদ্রাসায়। এতিমখানায় থেকে ওই মাদ্রাসায় পড়াশোনা করতেন তিনি। মাদ্রাসাটি থেকে ২০১৯ সালে দাখিল এবং ২০২১ সালে আলিম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। চলতি বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত ভর্তির টাকা জোগাড় করতে না পারায় দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে মাহমুদুলের।

মাহমুদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার জীবনটা কষ্টে গড়া। শত কষ্টের মধ্যেও নিজেকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। এতিমখানা থেকে বিনা মূল্যে শুধু খাবার দিত। প্রাইভেট পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচসহ অন্যান্য খরচ চালিয়ে এই পর্যন্ত এসেছি। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ভর্তির টাকা এবং ঢাকায় থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারিনি।’