দিনাজপুরের বাজারে উঠেছে টসটসে লিচু। বেদানা জাতের প্রতি হাজার লিচু ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বুধবার সকালে দিনাজপুর শহরের কালিতলা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

সারি সারি ভ্যানে সবুজ পাতায় মোড়ানো টসটসে লাল লিচু। দেখলেই যেন জিভে জল আসে। ভ্যান নিয়ে বাজারে প্রবেশ করতেই খুচরা বিক্রেতা ও আড়তদারেরা ঘিরে ধরছেন। এরপর পাতা সরিয়ে শুরু হচ্ছে হাঁকডাক। পরে উচ্চ দাম হাঁকা ক্রেতা ভ্যান নিয়ে আড়তঘরে যাচ্ছেন। মুখে হাসি নিয়ে টাকা গুনছেন লিচুচাষি।

প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দিনাজপুর শহরের কালীতলা এলাকায় পৌরসভার নিউমার্কেটের ফলের দোকানগুলোতে এখন ক্রেতা-বিক্রেতার ভিড়। সারি সারি ঝুড়িতে সাজিয়ে রাখা লিচু। প্রতিটি থোকায় ৫০টি লিচু। কেউ খুচরা বিক্রি করছেন, কেউবা দিচ্ছেন আড়তে। ক্রেতা দাম জিজ্ঞেস করতেই লিচুর থোকা উঁচিয়ে ক্রেতাকে আকৃষ্ট করছেন বিক্রেতা। এক সপ্তাহ ধরে নিউমার্কেটে লিচু বিক্রি চলছে। বিক্রেতারা বলছেন, এখনো অনেকের বাগানে লিচুতে পূর্ণ লাল রং আসেনি। লিচুর বাজার জমে উঠতে আরও সপ্তাহখানেক সময় লাগবে।

আজ বুধবার সকালে বাজারে মাদ্রাজি, বেদানা ও চায়না–থ্রি জাতের লিচুর দেখা পাওয়া গেল। চাষিরা বলছেন, বোম্বাই ও মোজাফফরপুরী জাতের লিচু বাজা‌রে আসতে আরও অন্তত সপ্তাহ দু‌য়েক সময় লাগ‌বে। ১ হাজার মাদ্রাজি লিচু বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার ৩০০ টাকায়। বেদানা লিচু ৫ হাজার ৫০০ থেকে ৬ হাজার ৫০০ টাকা। চায়না–থ্রি জাতের ১ হাজার লিচু বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকায়। তবে বাজারে মাদ্রাজি লিচুই বেশি। খুচরা বিক্রির পাশাপাশি আড়তদারেরা ঝুড়ি ও প্লাস্টিকের ক্যারেটে লিচু প্যাকেট করছেন। ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, সিলেটসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পাইকারেরা লিচু কিনতে এসেছেন। ট্রাকে করে সেসব লিচু বিভিন্ন জেলায় নেওয়া হচ্ছে।

দিনাজপুরের লিচুর খ্যাতি দেশজুড়ে। জেলার ১৩টি উপজেলাতেই কমবেশি লিচুর আবাদ হয়। সবচেয়ে বেশি চাষ হয় দিনাজপুর সদর উপজেলার মাসিমপুর, উলিপুর, আউলিয়াপুর, মহব্বতপুর, বিরল উপজেলার মাধববাটি, করলা, রবিপুর, মহেশপুর, বটহাট এবং চিরিরবন্দর ও খানসামা উপজেলায়। তবে গত বছরের চেয়ে এবার বেদানা, চায়না–থ্রি ও বোম্বাই লিচুর ফলন কম।

হাঁকডাকে মুখরিত লিচুর বাজার। বুধবার সকালে দিনাজপুর শহরের কালিতলা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

নিউমার্কেট এলাকার লিচুচাষি জিল্লুর রহমান বলেন, ১ হাজার ৩০০ গাছের বাগান তাঁর। এবার ফলন অর্ধেকে নেমেছে। তবে শুরুতেই দাম ভালো পাচ্ছেন। দুই দিন আগে প্রতি হাজার মাদ্রাজি লিচু বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৯০০ টাকায়। আজ বিক্রি করেছেন ২ হাজার ২০০ টাকায়। এই দাম আরও বাড়বে। তিনি আরও বলেন, বাজারে মালের জোগান কম, চাহিদাও আছে। তাই সামনের কয়েক দিন লিচুর দাম আরও বাড়বে।
আজ সকালে নিউমার্কেট এলাকা থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকায় ৫০০টি বেদানা জাতের লিচু কিনেছেন মাজেদুর রহমান। লিচুগুলো তিনি ঢাকায় আত্মীয়ের বাসায় পাঠাবেন। মাজেদুর বলেন, এবার শুরুতেই বেদানার দাম চড়া। ঝুড়ি কিনতে লাগবে ১০০ টাকা, কুরিয়ার চার্জ নেবে ৩৫০ টাকা—সব মিলিয়ে প্রতিটি লিচুর দাম পড়ল ৭ টাকা ৩০ পয়সা। দাম বেশি পড়লেও মাল ভালো পেয়েছেন।

প্রতিবছর লিচুর মৌসুমে লিচু বিক্রি, পরিবহন, বাঁশের খাঁচা তৈরি, শ্রমিকদের মজুরি—সব মিলিয়ে দিনাজপুরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।

লিচু ব্যবসায়ী শাহ আলম সরকার বলেন, এবার এখনো পাইকারি ব্যবসায়ীরা তেমন আসেননি। স্থানীয়ভাবেই লিচুর চাহিদা অনেক বেশি। ফলন কম হওয়ায় লিচুর বাজারও অনেক চড়া। আজ সকালে প্রতি হাজার বেদানা জাতের লিচু কিনেছেন ৬ হাজার ২০০ টাকা দরে। সর্বনিম্ন সাত হাজার টাকায় বিক্রি হবে। মালের দাম বেশি, গাড়িভাড়া বেশি। তবে এখনো যেহেতু বাজারটা ঠিকমতো জমেনি। হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যে দূরের পাইকারেরা আসতে শুরু করবেন।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় ৫ হাজার ৪৯০ হেক্টর জমিতে লিচুর বাগান আছে ৫ হাজার ৪১৮টি। এর মধ্যে বোম্বাই লিচু ৩ হাজার ১৭০ হেক্টর, মাদ্রাজি ১ হাজার ১৬৬ হেক্টর, চায়না-থ্রি ৮০২ হেক্টর, বেদানা ২৯৫ দশমিক ৫ হেক্টর, কাঁঠালি ৫৬ হেক্টর ও মোজাফফরপুরী লিচু ১ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। এ ছাড়া বসতবাড়ির উঠান, বাগানসহ লিচুগাছ আছে প্রায় সাত লাখ। এবার লিচু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন।

বাজারে জোগান কম, তাই চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে লিচু। বুধবার সকালে দিনাজপুর শহরের কালিতলা এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক নুরুজ্জামান বলেন, দিনাজপুরের লিচুর চাহিদা দেশব্যাপী। বিশেষ করে এখানকার বেদানা লিচু অত্যন্ত সুস্বাদু। গত বছর ২৮ মেট্রিক টন লিচুর ফলন হয়েছে, যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ মেট্রিক টন। তবে এবার বোম্বাই ও চায়না–থ্রি জাতের লিচুর ফলন কিছুটা কম। প্রতিবছর লিচুর মৌসুমে লিচু বিক্রি, পরিবহন, বাঁশের খাঁচা তৈরি, শ্রমিকদের মজুরি—সব মিলিয়ে দিনাজপুরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়।