কালেমা পড়েও রেহাই পাননি হিঙ্গুলীর ১২ বাসিন্দা

মিরসরাইয়ের হিঙ্গুলী ইউনিয়নে গণহত্যার শিকার শহীদদের কবর দেখাচ্ছেন স্থানীয় গ্রামবাসী। সম্প্রতি তোলাছবি: প্রথম আলো

গ্রামে ঢুকেই ঘরবাড়িতে আগুন দেওয়া শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। নিরুপায় হয়ে ১৪ জন গ্রামবাসীর একটি দল পাকিস্তানি সৈন্যদের সামনে গিয়ে বলেন, গ্রামে বসবাররতরা সবাই শান্তিপ্রিয় মানুষ এবং মুসলমান। তাঁদের বাড়িঘর যেন না পোড়ানো হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা এ কথা শুনে ওই ১৪ জনকে এক সারিতে বসে উচ্চ স্বরে কালেমা পড়তে বলেন। গ্রামবাসী কালেমা পড়া শুরু করতেই খুব কাছ থেকে তাঁদের ব্রাশফায়ার করা হয়। দুজন ভাগ্যবশত প্রাণে বেঁচে গেলেও ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় ১২ জনের।

১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ এ ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার হিঙ্গুলী ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামে। এই ঘটনার পর মানুষ শূন্য হয়ে যায় পুরো গ্রাম। লাশের খবরও কেউ নিতে পারেননি। তিন মাস পরে এলাকায় ফিরে স্বজনেরা খুঁজে পান নিহত ব্যক্তিদের হাড়-কঙ্কাল। একসঙ্গে মাটি চাপা দেওয়া হয় নিহত ১২ জনের দেহাবশেষ।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে এ পর্যন্ত লেখা কোনো বইয়ে হিঙ্গুলির জামালপুর গ্রামের এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি। তবে গ্রামবাসী, এলাকার মুক্তিযোদ্ধা এবং জনপ্রতিনিধিরা এ ঘটনার বিষয়ে নিশ্চিত করেছেন। নিহত ব্যক্তিদের ওই গণকবর এখনো স্বীকৃত নয়, এটি সংরক্ষণও করা যায়নি।

হত্যার শিকার ব্যক্তিরা হলেন জামালপুর গ্রামের সর্দার বাড়ির বাদশা মিয়া, কাজী বাড়ির দুই ভাই খুরশিদ আলম ও আমীর হোসেন, ফছি মিয়াজী বাড়ির রসুল আহম্মদ, সৈয়দের রহমান, মো. কবির; কেনু সওদাগর বাড়ির ছুট্টু মিয়া, চৌকিদার বাড়ির মো. হোছন, আমান উল্লাহ ভূঁইয়া বাড়ির মজল হক, সুলতান আহাম্মদ ভূঁইয়া বাড়ির মজিবুল হক, গান্ধি বাড়ির করিমুল হক, ভূঁইয়া বাড়ির আমিনুল হক।

বেঁচে যাওয়া দুজন হলেন আমানউল্লাহ ভূঁইয়া বাড়ির সৈয়দের রহমানের ছেলে কালা মোল্লা ও আবদুল মজিদ সারেং বাড়ির আবদুল মজিদের ছেলে সোনা মিয়া।

১২ জনকে হত্যার পরদিন একই এলাকার গনু সর্দার বাড়িতে ঢুকে পাকিস্তানি বাহিনী স্ত্রীর সামনে গুলি করে হত্যা করে ছদর আলীর ছেলে আবদুস সোবাহানকে। পরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিলে সে আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় আবদুস সোবাহানের মৃতদেহ। তাঁকেও দীর্ঘ সময় পরে উদ্ধার করে একই স্থানে সমাহিত করা হয় বলে জানিয়েছেন গ্রামবাসী।

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ দুপুরের পর উপজেলার বারৈয়ারহাট বাজার থেকে পশ্চিম দিকে শান্তরহাট সড়ক ধরে গ্রামে ঢুকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বড় একটি বহর। যাওয়ার পথেই নির্বিচারে গুলি ও বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছিলেন তাঁরা। বারিয়ারহাট বাজার লাগোয়া জামালপুর গ্রামে ঢুকেও বাড়ি বাড়ি আগুন দেওয়া শুরু হয়। এ অবস্থায় গ্রামের বেশ কিছু মানুষ জড়ো হন স্থানীয় গনু সর্দার বাড়িতে। সেখানে কয়েকজন মতামত দেন—মুসলিম পরিচয় দিলে হয়তো পাকিস্তানি সেনারা রেহাই দিতে পারেন। এ বিষয়ে গ্রামবাসীদের ১৪ জনের একটি দল পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে কথা বলতে যায়। যদিও শেষ পর্যন্ত মুসলিম পরিচয়েও রেহাই মেলেনি তাদের হাত থেকে। গুলি করে ১২ জনকে হত্যার পর লাশ না সরানোরও নির্দেশ স্থানীয় দোসরদের দিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী।

এ ঘটনায় প্রাণে বাঁচলেও পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন কালা মোল্লা ও সোনা মিয়া। ব্রাশফায়ারের পর তাঁদেরও মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায় পাকিস্তানি বাহিনী।

সম্প্রতি জামালপুর গ্রামে গিয়ে কথা হয় নিহত আবদুস সোবহানের নাতি মো. ফজলুল হকের সঙ্গে। তিনি একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। এলাকার আরও কয়েকজন প্রবীণ ব্যক্তিসহ তিনি বাড়ির অদূরে পাকা সড়কের সঙ্গে লাগানো একটি কবরস্থানের পাশে নিয়ে যান। পরে কবরস্থানের এক কোনায় বাঁশঝাড়ের নিচে একটি জায়গা দেখিয়ে দেন। এ স্থানটিতেই নিহত ব্যক্তিদের হাড়গোড় মাটিচাপা দেওয়া হয় বলে জানান তিনি।

ফজলুল হক বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র। তিন মাস পর স্বজনদের এলাকায় ফিরে নিহত ব্যক্তিদের হাড়-কঙ্কাল আর মাথার খুলি কুড়িয়ে ঝুড়িতে ভরার মর্মান্তিক দৃশ্যটি দেখেছি। সেই স্মৃতি আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। নানাভাবে চেয়েছি এ গণহত্যার বিষয়টি ইতিহাসে স্থান পাক। স্থানটি চিহ্নিত করে নিহত ব্যক্তিদের শহীদের মর্যাদা অন্তত রাষ্ট্র দিক।’

নিহত আমির হোসেনের ছেলে নূর ছোবহান বলেন, ‘তখন আমার বয়স ১০ বছর। ঘরবাড়ি বাঁচানোর আরজি নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে গিয়ে বাবা খুন হয়েছেন জানলেও কাছে গিয়ে দেখা বা লাশ কবর দেওয়ার সুযোগটুকুও পাইনি। কুকুর টেনেছিঁড়ে খেয়েছে বাবার লাশ। তিন মাস পর সবার হাড় কুড়িয়ে একসঙ্গে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। মানুষের সঙ্গে মানুষ যে কত নিষ্ঠুর হতে পারে, তার সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছি।’

জানতে চাইলে জামালপুর গ্রামের এই হত্যাকাণ্ডের সত্যতা নিশ্চিত করেন মিরসরাই উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সহকারী কমান্ডার এমএম কামাল পাশা। তাঁর বাড়িও হিঙ্গুলী ইউনিয়নে। তিনি বলেন, ‘গণকবর চিহ্নিত করে রক্ষার বিষয়ে সরকারের তেমন মনোযোগ দেখি না। এলাকার আরও কয়েকটি গণকবর চিহ্নিত করে দিয়েছিলাম আমরা। কিন্তু সেগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই জামালপুর গ্রামের গণহত্যা ও গণকবর চিহ্নিত করা ও সংরক্ষণের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি।’

হিঙ্গুলী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সোনা মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, জামালপুর গ্রামের গণকবরটির বিষয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রায় সবাই জানেন। তবু এটি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ এ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সরকারিভাবে এ গণকবরটি চিহ্নিত করে তালিকাভুক্ত করা প্রয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও গণহত্যার বিষয়ে গবেষণা করেন মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘মিরসরাই গিয়ে আগে আমরা বেশ কয়েকটি গণকবর শনাক্ত করলেও জামালপুর গ্রামের গণকবরটির বিষয়ে আমার জানা নেই। দেশে এখনো চিহ্নিত হয়নি এমন অনেক গণকবর রয়ে গেছে। অনেক গণহত্যার কথা লেখা সম্ভব হয়নি এখনো। মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস লিখতে এসব গণহত্যার কথা আর গণকবরের সংরক্ষণ খুব জরুরি।

মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন প্রথম আলোকে বলেন, হিঙ্গুলী ইউনিয়নের জামালপুর গ্রামের গণহত্যা ও গণকবরের বিষয়টি তাঁর জানা ছিল না। সত্যতা যাচাই করে গণকবরটি তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।