চট্টগ্রামে বিএনপির নেতা–কর্মীদের রাত কাটে অন্যের বাড়িতে
গ্রেপ্তার এড়াতে চট্টগ্রাম বিএনপির বেশির ভাগ নেতা–কর্মীর রাত কাটছে অন্যের বাসায়। নাশকতার অভিযোগের পুরোনো মামলায় তাঁরা আদালতে হাজিরাও দিচ্ছেন না, শুধু আইনজীবীর মাধ্যমে সময় নিচ্ছেন। হরতাল-অবরোধের সমর্থনে ঝটিকা মিছিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ তাঁদের আন্দোলন কর্মসূচি। নেতা–কর্মীদের দাবি, গণগ্রেপ্তার এড়ানোর কৌশল হিসেবে তাঁরা মিছিল করেই সরে পড়ছেন। তালাবন্ধ রয়েছে দলীয় কার্যালয়ও।
চট্টগ্রাম মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ—এই তিন ভাগে চট্টগ্রাম জেলা বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের পর থেকে চট্টগ্রাম বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার না হলেও ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ২৭৯ জন নেতা–কর্মী কারাগারে গেছেন।
২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয় ১ হাজার ৯৪৩টি। এসব মামলায় আসামি শীর্ষস্থানীয় নেতাসহ ৩৯ হাজার ৪৫৫ জন। আর গত ২৮ অক্টোবরের ঢাকার সমাবেশের পর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন মামলা হয় ৬২টি।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জামিনে থাকলেও বিএনপির নেতা–কর্মীরা যাতে আন্দোলনে অংশ নিতে না পারেন, সে জন্য ঘরে ঘরে গিয়ে পুলিশ তল্লাশি চালাচ্ছে। গ্রেপ্তার এড়াতে নেতা–কর্মীদের রাত কাটছে অন্যের বাড়িতে। এরপরও হরতাল-অবরোধের সমর্থনে তাঁরা রাস্তায় নামছেন। তবে কৌশলগত কারণে শীর্ষস্থানীয় নেতারা গ্রেপ্তার এড়াতে মিছিলে অংশ না নিয়ে নেতা–কর্মীদের সংগঠিত করছেন।
এক মাসের বেশি ঘরছাড়া
নগর বিএনপির সদস্যসচিব আবুল হাশেমের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে মামলার সংখ্যা ৮২। মাসে ২০ থেকে ২২ দিন তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের পর থেকে নগরের এনায়েত বাজার বাটালি রোডের বাসায়ও তিনি থাকতে পারছেন না। তাঁর অভিযোগ, পুলিশ প্রায় প্রতিদিনই বাসায় অভিযান চালায়। এ কারণে একেক দিন একেকজনের বাসায় রাতে থাকছেন।
আবুল হাশেমের আইনজীবী ইরফানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি আদালতের আশপাশের এলাকায় সাদাপোশাকে পুলিশের নজরদারি বেড়েছে। এ কারণে গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলগতভাবে কয়েকটি মামলায় হাজিরার পরিবর্তে সময়ের আবেদনও করা হয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে কোনোটিতে সাক্ষ্য চলছে। কোনোটি বিচার শুরুর জন্য রয়েছে।
একই অবস্থা চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ানেরও। তাঁর বিরুদ্ধে আগের মামলা রয়েছে ৫০টি। নতুন হয়েছে দুটি। তিনি জানান, ২৮ অক্টোবরের পর থেকে তিনি বাসায় থাকতে পারছেন না। আবার পুরোনো মামলায় আদালতে হাজির হতেও পারছেন না। আইনজীবীর মাধ্যমে সময় নিচ্ছেন।
নগর ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি গাজী সিরাজ উল্লাহর বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ২৮৪টি। ৫৪টির বিচার চলছে। বাকিগুলো বিচার শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। গাজী সিরাজ জানান, মাসের প্রতি কার্যদিবসে ছয় থেকে সাতটি মামলায় তাঁকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়। হাজিরা শেষে বিকেলে আর বাসায় ফিরতে পারেন না। বন্ধু, আত্মীয়স্বজনদের বাসায় তাঁর রাত কাটছে। কোন দিন কোথায় থাকবেন বুঝতে পারেন না। এ জন্য নগরের বিভিন্ন এলাকার ১২টি লন্ড্রিতে কাপড় রাখেন। যখন যেখানে–থাকেন আশপাশের লন্ড্রি থেকে কাপড় নিয়ে পরেন।
শুধু ওই তিনজন নন, নগর ও জেলার অন্তত ৫০ নেতা–কর্মীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ নেতা–কর্মীর অবস্থা একই। মামলা না থাকলেও ২৮ অক্টোবরের পর থেকে নগর ও জেলার বেশির ভাগ নেতা বাসায় থাকছেন না। নগরের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের এক বিএনপি নেতা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় কোনো মামলা নেই। হরতাল-অবরোধে রাস্তায় না নামতে সতর্ক করার জন্য পুলিশ প্রতি রাতে বাসায় অভিযান চালাচ্ছে। এ জন্য তিনি বাসায় থাকছেন না।
গ্রেপ্তার ও মামলা
২৮ অক্টোবরের ঢাকার সমাবেশের পর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন মামলা হয় ৬২টি, গ্রেপ্তার হন ১ হাজার ২৭৯ জন। নগর বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বে থাকা ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির চলমান অবরোধকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে গায়েবি অভিযোগ তুলে পুলিশের সদস্যরা এখন বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতি রাতে তল্লাশির নামে হয়রানি ও নির্বিচার গ্রেপ্তার করছেন। নেতা-কর্মীদের বাড়িতে না পেলে পরিবারের অন্য সদস্যদের ধরে নিয়ে যাচ্ছেন।
তবে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (গণমাধ্যম) স্পিনা রাণী প্রামাণিক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ অহেতুক কাউকে হয়রানি করছে না। মামলা রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের পুলিশ ধরছে। আর যারা গাড়ি পুড়ছে, নাশকতায় জড়িত, তাদের ধরা হচ্ছে।
তালাবন্ধ দলীয় কার্যালয়
নগরের কাজীর দেউড়ি নুর আহমদ সড়কে নগর ও উত্তর জেলা এবং নিউমার্কেট দোস্ত বিল্ডিংয়ে দক্ষিণ জেলা বিএনপির কার্যালয় অবস্থিত। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে এগুলো তালাবন্ধ। হরতাল-অবরোধের কোনো কর্মসূচিতে দেখা যায়নি নেতা–কর্মীদের।
নগর বিএনপির আহ্বায়ক শাহাদত হোসেন, সদস্যসচিব আবুল হাশেম—দুজনই সক্রিয় রয়েছেন। দুজনেরই দাবি, কৌশলগত কারণে তাঁরা আড়ালে থেকে নেতা–কর্মীদের সংগঠিত করে মাঠে রাখছেন। মাঝেমধ্যে নেতা–কর্মীরা ঝটিকা মিছিল বের করেন। শুরু থেকে মাঠে সক্রিয় রয়েছেন দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান। অবরোধ–হরতালে ঝটিকা মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন তিনি। কিন্তু সদস্যসচিব মোস্তাক আহমদ খানকে দেখা যায় না। তবে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন বলে জানান।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক বলেন, রাস্তায় নামলেই পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই আড়ালে থেকে শীর্ষ নেতারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।
পুরোনো মামলার বিচার শেষ হয়নি
নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা পরিচালনার জন্য ১৫০ সদস্যের লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। কমিটির সদস্যসচিব কামরুল ইসলাম সাজ্জাদ প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা হয় ১ হাজার ৯৪৩টি। এতে আসামি করা হয় শীর্ষ নেতাসহ ৩৯ হাজার ৪৫৫ জনকে। এর মধ্যে অন্তত ১ হাজার ১০০ মামলার বিচার শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি।
কামরুল ইসলাম দাবি করেন, মামলাগুলোর মধ্যে গায়েবি মামলাও রয়েছে। ঘটনার সময় বিদেশে, কারাগারে থাকা, মৃত ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়েছিল। যেহেতু মৃত, কারাগারে থাকা ব্যক্তি ককটেল ছুড়ে মেরেছিলেন বলে মামলায় বলা হয়েছে, তাতে বোঝা যায় পুরো ঘটনাই মিথ্যা। এসব বিষয় আদালতে তুলে ধরা হচ্ছে।
তবে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে নাশকতার অভিযোগের সত্যতা উঠে এসেছে। রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষ্য–প্রমাণ আদালতে তুলে ধরছে। আশা করা যায়, যত দ্রুত সম্ভব এসব মামলা নিষ্পত্তি হবে।