চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সাত ইউপিতে চেয়ারম্যানরা আসছেন না, সেবা বন্ধ
সীতাকুণ্ড উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন পরিষদের চিত্রই এমন। সোনাইছড়ির বাইরে বাকি ছয়টি ইউনিয়ন হলো সৈয়দপুর, মুরাদপুর, বাড়বকুণ্ড, বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা ও সলিমপুর। ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৩৯ বাসিন্দার এসব ইউনিয়নে ২০ দিন ধরে মিলছে না নাগরিক সেবা।
ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) বারান্দায় একটি কাঠের বেঞ্চে বসে রয়েছেন জেবল হক। হাতে তাঁর জাতীয়তা সনদের ফরম, সঙ্গে পাসপোর্টের আবেদনপত্র আর প্রয়োজনীয় কাগজ। এসেছিলেন সকাল ১০টায়। তবে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষার পর জানলেন চেয়ারম্যান আসছেন না। পরিষদের সব ধরনের সেবা বন্ধ রয়েছে।
জেবল হক চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সোনাইছড়ি ইউনিয়নের বাসিন্দা। গত বৃহস্পতিবার কথা হয় তাঁর সঙ্গে। আক্ষেপ নিয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাসপোর্টের আবেদন করতে জাতীয়তা সনদ লাগবে। আর জাতীয়তা সনদ চেয়ারম্যানের সই ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। কখন এই জাতীয়তা সনদ তুলতে পারবেন তা জানেন না।
অবশ্য শুধু সোনাইছড়ি ইউনিয়ন নয়। সীতাকুণ্ড উপজেলার সাতটি ইউনিয়ন পরিষদের চিত্রই এমন। সোনাইছড়ির বাইরে বাকি ছয়টি ইউনিয়ন হলো সৈয়দপুর, মুরাদপুর, বাড়বকুণ্ড, বাঁশবাড়িয়া, কুমিরা ও সলিমপুর। ৩ লাখ ১৫ হাজার ৬৩৯ বাসিন্দার এসব ইউনিয়নে ২০ দিন ধরে মিলছে না নাগরিক সেবা।
উপজেলা প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, এই সাত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানদের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। গত বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই এসব ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্যরা কার্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন। এরপর ১৯ সেপ্টেম্বর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) এসব ইউনিয়নের আর্থিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। এরপর কিছুদিন ইউনিয়ন পরিষদের পরিষেবার কার্যক্রম চলে। তবে চলতি বছরের ২৩ জুন এই দায়িত্ব পালনের ওপর স্থগিতাদেশ দেন উচ্চ আদালত। ফলে আবার চেয়ারম্যানরা প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা ফিরে পান। তবু তাঁরা পরিষদে ফিরছেন না। তাঁদের দাবি, পরিষদে ফেরার মতো নিরাপদ পরিবেশ নেই। আর উপজেলা প্রশাসন বলছে, আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী তাঁরা কাজ করছেন।
জুলাইয়ের শুরুতেই আমার দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের প্রয়োজন হয়। আমি যথাসময়ে আবেদন করলেও চেয়ারম্যান না থাকায় ফাইল আটকে রয়েছে। ফলে নতুন অর্থবছরের দরপত্রে অংশ নিতে পারছি না। আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, বাসিন্দা, সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়ন
সেবা না থাকায় ভোগান্তিতে পড়েছেন এসব অঞ্চলের নাগরিকেরা। সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা ব্যবসায়ী কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জুলাইয়ের শুরুতেই আমার দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স নবায়নের প্রয়োজন হয়। আমি যথাসময়ে আবেদন করলেও চেয়ারম্যান না থাকায় ফাইল আটকে রয়েছে। ফলে নতুন অর্থবছরের দরপত্রে অংশ নিতে পারছি না। আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।’
ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ট্রেড লাইসেন্স ছাড়াও জন্মসনদ, মৃত্যুসনদ, ওয়ারিশান সনদ, বিবাহিত সনদ, নাগরিকত্ব সনদ, চারিত্রিক সনদসহ অন্তত ২০ ধরনের সেবা সাধারণ মানুষ পেয়ে থাকেন। কিন্তু চেয়ারম্যানরা দায়িত্বে না ফেরায় পুরো সেবাব্যবস্থা অচল হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদের সচিব আবুল কাশেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চেয়ারম্যান আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন না। ফলে কোনো সনদ ইস্যু করা যাচ্ছে না। সেবাপ্রার্থীদের বারবার বোঝালেও অনেকেই রাগ করছেন, তর্ক করছেন।’
সীতাকুণ্ডের চেয়ারম্যান সমিতির সভাপতি ও সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাজুল ইসলাম নিজামী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। তাঁরা জনগণকে সেবা দিতে চান। কিন্তু পরিষদে যাওয়ার পরিবেশ নেই। সরকার তাঁদের নিরাপত্তা দিলে তাঁরা কাজে ফিরবেন। বক্তব্য জানতে চেয়ে বাকি ছয় চেয়ারম্যানের মুঠোফোনে কল করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ফখরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মানুষের দুর্ভোগের বিষয়টি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে জানিয়েছেন। মন্ত্রণালয় যেভাবে সিদ্ধান্ত দেবে তাঁরা সেভাবে কাজ করবেন।
বিএনপির সংবাদ সম্মেলন
এদিকে এই সাত ইউনিয়ন পরিষদের দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দেওয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে উপজেলা বিএনপি। গত শনিবার বিকেলে সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবে এই সম্মেলন হয়। সীতাকুণ্ডের সর্বস্তরের জনগণের ব্যানারে এতে দাবি করা হয় অবৈধভাবে নির্বাচিত চেয়ারম্যানরা নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে পালিয়ে জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব কাজী মহিউদ্দিন বলেন, চেয়ারম্যান পরিষদে না আসায় ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তিনি চেয়ারম্যানদের পরিষদের এসে জনগণের ভোগান্তি লাঘব করার আহ্বান জানিয়েছেন।
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমল কদর বলেন, ‘৯০ দিন পরিষদে হাজির না হলে কিংবা তিনটি মাসিক সভায় উপস্থিত না থাকলে চেয়ারম্যানদের পদ থাকার কথা নয়। এত দিন অনুপস্থিত থাকার পরও সেই সাত ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের পদ কীভাবে থাকে সেটি বড় প্রশ্ন।’