মণ্ডপে ঢুকেই চোখ জুড়িয়ে গেল। পাটের কাঠি, খড়, বাঁশ, দড়ি—কত কিছু দিয়েই না ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য। শোভা পাচ্ছে মাটির ঘর, বাঁশের মূর্তি। পরিবেশবিধ্বংসী প্লাস্টিকের কোনো ব্যবহার নেই। নেই গতানুগতিক নির্মাণশৈলী।
চট্টগ্রাম নগরের হাজারী লেনের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজার মণ্ডপে আজ শুক্রবার যখন যাই, তখন ঘড়ির কাঁটা দুপুর ১২টার ঘরে। চলছিল ষষ্ঠী পূজার আয়োজন। মণ্ডপে বাজছিল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অমর সৃষ্টি ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’ সুর। হাজারী লেন সর্বজনীন দুর্গা উৎসব উদ্যাপন পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম, এবার তাঁদের পূজার থিম ‘প্রাণ-প্রকৃতির টানে’। ব্যস্ত নগরের বুকে তাঁরা ফিরিয়ে এনেছেন সবুজ-শ্যামল গ্রামের নানা রূপ।
গতানুগতিক ধারা ভেঙে থিম ধরে মণ্ডপ সাজানো চট্টগ্রামে প্রায় দুই যুগ আগে শুরু হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে প্রথম সারিতে আছে হাজারী লেনের নাম। তারা কখনো অগ্ন্যুৎপাতে রোমান সাম্রাজ্যের পম্পেই নগর ধ্বংস ও পুনরুত্থান দেখিয়েছে। আবার কখনো অসুর বদের আখ্যান তুলে ধরে সাড়া জাগিয়েছে।
হাজারী লেন সর্বজনীন দুর্গা উৎসব উদ্যাপন পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী জানালেন, প্রায় দুই দশক আগে চট্টগ্রামে তাঁরা থিমনির্ভর মণ্ডপ সাজানোর কাজ শুরু করেছিলেন। ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে শুরু করে বর্তমানের নানা সচেতনতামূলক প্রসঙ্গ উঠে আসে এসব থিমে। যা দর্শনার্থীদের দেয় অন্য রকম অভিজ্ঞতা।
এবারের থিমের ব্যাখ্যা করে জহর লাল হাজারী বললেন, ‘নগরায়ণ ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় অনেকেই গ্রামবাংলার ঐতিহ্যকে ভুলে যাচ্ছে। আমরা খড়, পাটকাঠি, বাঁশ-বেতের বিভিন্ন অংশ, চটের বস্তা, পাটি দিয়ে থিম তৈরি করেছি। অসুরবিনাশী দুর্গার গায়েও প্লাস্টিকের তৈরি কোনো গয়না ব্যবহার করা হয়নি। প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে, এমন কিছুই ব্যবহার করা হয়নি।’
হাজারী লেনের থিমটি দেখতে সব মিলিয়ে তিন মিনিট সময় লাগল। এই সময়ে আলোকসজ্জার পাশাপাশি বাজছিল কবিগুরুর গানটি। গান শেষে ছিল প্রকৃতিকে ভালোবাসার বার্তা।
এই থিম দেখে চলে গেলাম টেরিবাজার এলাকায়। ‘আমাদের এই পূজার শহর’ থিমের নানা দৃশ্য মুঠোফোনে বন্দী করে যাচ্ছিলেন দর্শনার্থীরা। এই থিমটি একটু ব্যতিক্রম। উৎসবের পাঁচটা দিন রং-তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পীরা। প্রতিমা তৈরির কর্মযজ্ঞ, মহালয়া, দেবীর আগমন, ঢাকঢোলের মূর্ছনা, ধুনুচি নৃত্য, পূজার নানা ধাপ, চণ্ডীপাঠ, শহরের মণ্ডপে শিশুদের উচ্ছ্বাস, মা-মাসিদের ব্যস্ততা—সবই ধরা পড়েছে বড় ক্যানভাসে।
কথা হলো টেরিবাজার বাই লেন পূজা উদ্যাপন পরিষদের সহ–অর্থ সম্পাদক শুভ রায়ের সঙ্গে। তিনি বললেন, পূজা মানেই আনন্দ, উচ্ছ্বাস। সেই উচ্ছ্বাস দর্শনার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে দুই মাস ধরে তাঁরা পরিশ্রম করেছেন। সকাল থেকে ভিড় দেখে মনে হচ্ছে, তাঁদের সব কষ্ট সফল হয়েছে।
মণ্ডপটিতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল শিশু, তরুণেরা। ১৩ বছর বয়সী অনিরুদ্ধ রায় ও তাঁর দুই বন্ধুর কাছে জানলাম, এবার হাজারী গলি, টেরিবাজার ছাড়াও দক্ষিণ নালাপাড়ার থিম তাদের বেশ ভালো লেগেছে। তারা গতকাল বৃহস্পতিবারই ঘুরে এসেছে। দক্ষিণ নালাপাড়া যাওয়ার পরামর্শ দিল তারা। ফলে আর দেরি করলাম না। ছুটলাম সেদিকে। দক্ষিণ নালা পাড়ার পূজামণ্ডপে ঢোকার আগেই চোখ আটকে গেল এলাকাটির দেয়ালে দেয়ালে। কোনোটিতে দেবী দশভুজা, কোনোটিতে পুণ্যার্থীর অবয়ব আঁকা। কেউ আবার ধুনুচি নিয়ে আরাধনা করছেন।
এই মণ্ডপটি যেন বিসর্জনের বিষাদে ভরা। চতুর্ভুজ আকৃতিতে বানানো মণ্ডপের মূল ফটক পেরোতেই সেই বিষাদ হৃদয়ে নাড়া দিল। দেখলাম, এক সারি মূর্তি এগিয়ে যাচ্ছে বিসর্জনের পথে। সবার প্রথমে দেবী দুর্গা। এরপর লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরা দুই নারীর সিঁদুর খেলা। মূর্তিগুলোর কেউ ধুনুচি নাচছে, কেউ ঢাক বাজাচ্ছে, কারও মুখে শঙ্খ। মণ্ডপের দুই পাশে বসানো হয়েছে মাটির প্রদীপ। সব আলো জ্বলে ওঠার পর এই অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য মনটাকে রাঙিয়ে দিল।
দক্ষিণ নালাপাড়া সর্বজনীন পূজা উদ্যাপন পরিষদের সহসভাপতি অলকেশ পাল ও নির্বাহী সদস্য রাজীব বিশ্বাসকে পাওয়া গেল মণ্ডপে। থিমের পুরো চিত্র ধরা পড়ল তাঁদের কথায়। বললেন, ‘এবার তাঁদের থিমের নাম বিজয়া। দেবী দুর্গা অসুরকে বদ করার মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অধর্মের বিনাশ করে বিজয়ী হয়েছিলেন। সেই বিজয়কে শিল্পে প্রকাশ করেছেন তাঁরা। রাজীব বিশ্বাস বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর বিজয় এবং শান্তির বার্তা পৌঁছানোর ভাবনা মাথায় নিয়ে বিজয়া থিমটি তৈরি করেছেন।
আজ ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের শুরু হলো। চট্টগ্রাম নগরের ২৭৭টি মণ্ডপে যেন আনন্দধারা বইছে। উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে উঠেছে এসব মণ্ডপ।