দুই সাধারণ সম্পাদকের লড়াই 

জেলা ও উপজেলার দুই শীর্ষ নেতা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

মোহাম্মদ আবুল হোসেন , বিজন কুমার চন্দ ও মো. হাফিজুর রহমান

প্রথম ধাপে জামালপুর সদর উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৮ মে। এই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দুজন সাধারণ সম্পাদক একে অপরের বিরুদ্ধে লড়ছেন। একজন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিজন কুমার চন্দ। তিনি মোটরসাইকেল প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন। আরেকজন সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হাফিজুর রহমান ওরফে স্বপন। তিনি কাপ-পিরিচ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছেন। জেলা ও উপজেলার দুই শীর্ষ নেতা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন।

এই দুজন ছাড়াও আওয়ামী লীগের আরও তিনজন চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। তাঁরা হলেন বর্তমান উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন (আনারস প্রতীক), সংসদ নির্বাচনে সংগঠনবিরোধী অবস্থানের কারণে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া আসাদুজ্জামান আকন্দ (দোয়াত কলম প্রতীক) এবং সদর উপজেলার রানাগাছা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আহসানুল ইসলাম (ঘোড়া প্রতীক)।

দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিজন কুমার চন্দ ২০০৯ সালে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মো. আমজাদ হোসেন ওরফে ভোলা মল্লিকের কাছে পরাজিত হন তিনি। ২০১৫ সালে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইন প্রণয়নের পর থেকে স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করে আসছে রাজনৈতিক দলগুলো। ২০১৯ সালে বিজন কুমার চন্দ চেয়ারম্যান পদে দলীয় মনোনয়ন চান। সেবার দলীয় মনোনয়ন পান মোহাম্মদ আবুল হোসেন। বিজন কুমার চন্দসহ অন্যরা আর প্রার্থী না হওয়ায় মোহাম্মদ আবুল হোসেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

এবার ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন বিজন কুমার চন্দ আবারও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হয়েছেন। তবে এবার সারা দেশে উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী দেবে না। বিজন কুমার চন্দের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী এবার হাফিজুর রহমান। হাফিজুর রহমান সদর উপজেলার ইটাইল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তিনবারের চেয়ারম্যান। তবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় চেয়ারম্যান পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন। একই সঙ্গে তিনি দীর্ঘদিন ধরে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। বয়স ও রাজনীতির অভিজ্ঞতায় বিজন কুমার চন্দ এগিয়ে থাকলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে ভোটের হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিতে পারেন হাফিজুর রহমান।

দলের দুই শীর্ষ নেতার লড়াইয়ে কয়েকজন ভোটার সংঘাতের শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।

দলীয় নেতা-কর্মী ও সাধারণ ভোটাররা বলছেন, বর্তমান চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবুল হোসেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে তাঁর ভোটব্যাংক তেমন নেই। এই নির্বাচনে মূল লড়াই বিজন কুমার চন্দ ও হাফিজুর রহমানের মধ্যেই হবে।

নির্বাচন নিয়ে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সাতজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, জেলা ও উপজেলার দুই শীর্ষ নেতা পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় দলের নেতা-কর্মীরা বেকায়দায় পড়েছেন। দুজনকে আবার দলের অনেক শীর্ষ নেতারা সমর্থন দিয়ে মাঠে রয়েছেন। নেতা-কর্মীরা কিছুটা ভয়ের মধ্যেও রয়েছেন। সবকিছু মিলিয়ে নির্বাচনের মাঠ এখন গরম।

২৩ এপ্রিল প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে প্রার্থীরা জোরেশোরে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিজন কুমার চন্দ ও হাফিজুর রহমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এখন জয়ের জন্য মরিয়া মোহাম্মদ আবুল হোসেনও। তাঁরা ছোট ছোট পথসভা, বৈঠকের সঙ্গে বড় বড় জমায়েতের সভাও করছেন। একটি পৌরসভা ও ১৫টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই উপজেলায় প্রার্থীদের এলাকাভিত্তিক ভোটের হিসাবও কষছেন অনেকে।

পৌর শহরের ১০ জন ও ইউনিয়ন পর্যায়ের ৭ জন ভোটারের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, ইউনিয়ন পর্যায়ের হাফিজুর রহমানের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। তবে পৌরসভায় হাফিজুরের জনপ্রিয়তা নেই। এদিকে বিজন কুমার চন্দের পৌরসভায় জনপ্রিয়তা রয়েছে। সেই সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় দলীয় ভোটাররা তাঁর দিকে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। দলের দুই শীর্ষ নেতার লড়াইয়ে কয়েকজন ভোটার সংঘাতের শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন।

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ শানিয়াজ্জামান তালুকদার বলেন, ভোট নিয়ে শঙ্কার কিছু নেই। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

চেয়ারম্যান প্রার্থী ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বলেন, দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ভোট চেয়ে যাচ্ছি। জয়ের ব্যাপারে আমি আশাবাদী। এবারের নির্বাচন উন্মুক্ত। নেতা-কর্মীরা অনেকেই যাঁর যাঁর মতো করে প্রার্থীদের সঙ্গে কাজ করছেন। তবে নির্বাচনের পর আমরা সবাই আবার একসঙ্গে দলীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করব। এখানে কোনো সমস্যা হবে না।

চেয়ারম্যান প্রার্থী ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বিজন কুমার চন্দ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে একবার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। ভোটাররা আমাকে ভোট দেবেন—এমন প্রত্যাশা রয়েছে আমার।’ দলের দুটি প্রধান ইউনিটের দুই শীর্ষ নেতা প্রার্থী হওয়ায় দলের মধ্যে বিভক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে কি না—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে আমার দলীয় কোনো প্রভাব নেই। এখানে আমি শুধুই একজন প্রার্থী হিসেবে সাধারণ ভোটার ও নেতা-কর্মীদের দ্বারে দ্বারে ভোট প্রার্থনা করছি। ফলে দলের মধ্যে কোনো ধরনের বিভক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।’