আড়াই লাখে শুরু করা হাজ্জাজ আলীর খামারের মূল্য এখন ৪ কোটি
প্রতিবছর কোরবানির পশুর হাটে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকে হাজ্জাজ আলীর খামারের গরু। এ গরু কেনার পর তাঁরা ঢাকায় নিয়ে বিচিত্র সব নাম দিয়ে বিক্রি করেন। এর অন্যতম কারণ, হাজ্জাজ আলীর খামারের গরু দেখতে যেমন বলবান ও সুন্দর হয়ে থাকে, তেমনি গায়ের রং ও আকারেও আকর্ষণীয়। উন্নতজাতের গরু উৎপাদন, পালন ও বিপণনে রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর খ্যাতি।
মূলত শৌখিন ব্যক্তিরাই হাজ্জাজ আলীর খামারের গরুগুলোর প্রধান ক্রেতা বলে জানিয়েছেন তিনি। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, বিশেষ করে বড় বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ সুন্দর ও সুস্থ-সবল পশু কোরবানি দেওয়ার পাশাপাশি সংগ্রহ সমৃদ্ধ করতে তাঁর কাছ থেকে গরু কেনেন। সঙ্গে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা তো আছেনই।
হাজ্জাজ আলীর বাড়ি চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাদিমপুর ইউনিয়নের কান্তপুর গ্রামে। সেখানকার মাথাভাঙ্গা নদীর তীরে প্রাকৃতিক পরিবেশে বাবার নামে গড়ে তুলেছেন তাজ উদ্দিন এগ্রো নামের এ খামার।
সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর ২০০৭ সালে গড়ে তোলেন খামারটি। তবে ২০০৮ সালে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটে। ওই বছর আলমডাঙ্গা পশুর হাট থেকে ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকায় একটি ষাঁড় কেনেন হাজ্জাজ আলী। কয়েক মাস পালনের পর ওই বছরের কোরবানির সময় ঢাকার একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের কাছে তা বিক্রি করেন ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকায়।
হাজ্জাজ আলী বলেন, শুরুতে ১৮ হাজার টাকা দরে ৮টি গরু কিনে খামারের যাত্রা শুরু করা হয়। সে সময়ে গরু ও অবকাঠামো মিলে মোট ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। এখন সব মিলিয়ে খামারটি চার কোটি টাকার সম্পদে পরিণত হয়েছে।
গত বছর কোরবানির ঈদে মোট ৬৫টি গরু ৪ কোটি টাকায় বিক্রি করেন হাজ্জাজ আলী। তিনি জানিয়েছেন, এ বছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে তাঁর খামারের ৪০টি গরু ইতিমধ্যে বিক্রি হয়ে গেছে। এসব গরুর প্রতিটির মূল্য সর্বনিম্ন ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা। খামারে বর্তমানে আমিরকান ব্রাহমা ও নিলর, শাহিওয়াল, হোরস্টাইন ফ্রিজিয়ান, ব্রাহমা ক্রস (দেশি গাভির সঙ্গে শংকর) এবং দেশি জাতের ৭৩টি ষাঁড় ও গাভি রয়েছে।
হাজ্জাজ আলী বলেন, ক্রেতারা ইতিমধ্যে ব্রাহমা গরুটির দাম ৪০ লাখ এবং নিলরের দাম ২৫ লাখ টাকা দিতে চেয়েছেন, তবে তিনি বিক্রি করেননি। আগামী বছর কোরবানির পশুর হাটে চমক দেখানোর জন্য এই দুটি গরু রেখে দিতে চান। খামারের গরুগুলোর মধ্যে এ বছর আর ২০টি বিক্রি করা হবে, যেগুলোর মূল্য ছয় লাখ টাকা থেকে শুরু।
হাজ্জাজ আলীর খামার দেখে এলাকার অনেকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গরুর খামার গড়ে তুলে সফল হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে আলমডাঙ্গা উপজেলার রামচন্দ্রপুরের বিল্লাল হোসেন ও যুগীরহুদা গ্রামের ইসরাইল হোসেন এবং দামুড়হুদা উপজেলার ইব্রাহিমপুরের রবিউল রয়েছেন।
খামারি ইসরাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মূলত দেশি জাতের গরু পালন করে থাকেন। প্রতিবছর কোরবানির পর মাঝারি আকারের গরু কেনেন এবং প্রায় এক বছর লালন-পালন শেষে সেগুলো কোরবানির হাটে বিক্রি করেন। এ বছর মোট সাতটি গরু পালন করেছেন। এগুলোর প্রতিটি ২ লাখ ১০ হাজার থেকে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা দরে বিক্রি করেছেন।
ইসরাইল হোসেনও প্রথমে ছোট পরিসরে খামার গড়ে তুলেছিলেন। তিনি আরও বলেন, প্রতিবছর গরুর সংখ্যা বাড়াচ্ছেন। এতে বছরে খরচ বাদে যে লাভ হয়, তাতে পরিবার–পরিজন নিয়ে ভালো আছেন।
হাজ্জাজ আলীর খামারের গরুর ক্রেতাদের বড় অংশই পূর্ব পরিচিত, যাঁদের কাছে সেরা গরু মানেই তাঁর খামারের গরু। এ জন্য কোরবানির পাঁচ–ছয় মাস আগে থেকে শৌখিন ক্রেতা ও ব্যবসায়ীদের অনেকে আসেন চুয়াডাঙ্গায় তাঁর খামারে। তাঁরা পছন্দের গরু নির্বাচন করে অগ্রিম টাকা দিয়ে যান। বিক্রিত গরু কোরবানির আগমুহূর্তে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেন তিনি।
হাজ্জাজ আলী বলেন, ‘আমি নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম ছড়িয়ে দিতে চাই। এ জন্য আমার খামারের গরুর আলাদা নাম দিই না। তবে অনেক মৌসুমী ব্যবসায়ী আমার খামারের গরু কিনে বিচিত্র সব নাম দিয়ে বড় বড় পশুর হাটে বিক্রি করেন। গত বছর কোরবানির হাটের আলোচিত গরু আরডিএক্স এবং এ বছরের এখন পর্যন্ত অন্যতম আলোচিত গরু আরডিএক্স-২ আমার খামারের।’
দেশজুড়ে হাজ্জাজ আলীর খ্যাতি রয়েছে জানিয়ে জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা মিহির কান্তি বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, উন্নত জাতের গরু পালনের জন্য তিনি উপজেলা, জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে অনেকবার পুরস্কৃত হয়েছেন। সম্মান বয়ে এনেছেন চুয়াডাঙ্গার জন্য।
মিহির কান্তি বিশ্বাস আরও বলেন, এবার জেলায় ছোট-বড় খামারগুলোয় মোট ৪৪ হাজার ৩১৭টি ষাঁড় পালন করা হচ্ছে। কোরবানির চাহিদা মিটিয়েও অন্তত ২৫ শতাংশ ষাঁড় উদ্বৃত্ত থাকবে, যেগুলো জেলার বাইরে বিক্রি করা হবে।