সোনা পাহাড়ের মায়া

সোনা পাহাড়ের ভেতরে বিশাল জলাশয়। তীরে পাটাতনে বসে অবকাশ যাপন। চারপাশে সবুজের বিস্তারছবি: সোনা পাহাড় কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে

দক্ষিণ সোনা পাহাড়। চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার একটি পাহাড়ি জনপদের নাম। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে কিছু মানুষ এখানে প্রকৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয়, পৃথিবীজুড়ে পরিবেশ ও উন্নয়নের দ্বন্দ্বে যেখানে সবুজ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে, মানুষের হাতে প্রকৃতির নিধনযজ্ঞ চলছে সবখানে, সেখানে প্রকৃতিকে নিজের মতো থাকতে দেওয়ার এ উদ্যোগ মানুষকে মুগ্ধ করে।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে মিরসরাই এলাকায় মেঘের মতো আবছা দেখা যায় সোনা পাহাড়। তার পাশে সমতল ভূমিতে ইটভাটার জন্য মাটি কাটা আর বৃক্ষ নিধনের উৎসব চলত। মাটি কেটে ফেলায় এলাকাটি হয়েছিল বড় বড় খাদসর্বস্ব গাছশূন্য প্রান্তর। অতীতের সব সমৃদ্ধি আর শোভা হারিয়ে জীর্ণদশা থেকে সোনা পাহাড়কে বাঁচাতে প্রকৃতিবাদী কিছু মানুষ নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এলাকার আদি পরিবেশ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। এ উদ্যোগের নাম দেন সোনা পাহাড়। কয়েক বছরের প্রচেষ্টায় সোনা পাহাড় হয়ে উঠেছে দুর্লভ ভেষজ, ফলদ ও ফুল গাছের নিবিড় বনভূমি। খাদগুলোকে তাঁরা পরিণত করেছেন স্বচ্ছ জলাশয়ে। জলাশয়ের পাশে বসে অবিরাম পাখির ডাক শুনতে শুনতে কেমন মায়া হয়।

সোনা পাহাড়ের অন্যতম উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘প্রকৃতির এখন বড় সংকট। সংকট থেকে রক্ষা পেতে প্রকৃতিকে বাঁচাতে হবে। এটা কারও একার পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা একটা উদাহরণ তৈরি করতে চাই। একটা ছোট জায়গায় কাজ করে দেখছি। এটা দেখে কেউ যদি উৎসাহিত হয়, প্রকৃতির প্রতি যদি সদয় হয়, নিজেরাও যার যার এলাকায় ছোট করে হলেও সোনা পাহাড়ের মতো একটা জায়গা তৈরি করতে পারে।’

সোনা পাহাড়ের আশপাশে এখনো ইটভাটা আছে। এখানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মুরগির খামার ছিল। তারও আগে এটি ছিল ইটের ভাটার জন্য মাটি সংগ্রহের স্থান। স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘কিছু বড় ও পুরোনো গাছ ছাড়া পুরো জায়গাটা খটখটে ছিল। কিছু মানুষ এখানে গাছপালা লাগাইছে। বড় সুন্দর হইছে।’

সোনা পাহাড়ের আয়তন প্রায় ৬ একর বা ১৮ বিঘা। এখানে চারটি জলাশয় আছে। এগুলোর আয়তন ১ দশমিক ৭৮ একর। চারপাশে গাছপালার ভেতর আকাশ ও কুসুম নামে দুটি ঘর তৈরি করা হয়েছে। মাধবীলতা নামে একটি দোতলা ভবন ও ডেক আছে। পুকুরের পানির ওপর একটি ডেক এবং পুকুরদ্বীপের ওপর একটি দোতলা ডেক রয়েছে। সব মিলিয়ে সোনা পাহাড়কে মনে হবে প্রকৃতিবান্ধব একটি পর্যটনকেন্দ্র।

দোতলা ভবন মাধবীলতার পাশেই রয়েছে ফুল ও ফলের গাছে ঘেরা সুইমিংপুল
ছবি: সোনা পাহাড় কর্তৃপক্ষের সৌজন্যে

গত পয়লা বৈশাখ সোনা পাহাড়ের উদ্যোক্তারা নববর্ষে উৎসবের আয়োজন করেন। চট্টগ্রাম থেকে কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মীরা গিয়েছিলেন। কোকিল আর বউ কথা কওসহ অসংখ্য পাখির ডাকের ভেতর গাছপালার ছায়ায় ঘাস বিছানো মাঠে ফুলের ঘ্রাণে ঘ্রাণে তাঁরা উপভোগ করেছিলেন লোকগান আর বাঁশির সুর।

সেদিন গাছপালার ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম কারিপাতা, পদ্ম, মেথি, স্টেভিয়া, শেকরাজ, গোলপাতা, মহুয়া, অনন্তমূল, অশ্বগন্ধা, আগর, মহুয়াসহ অর্ধশতাধিক ভেষজ গাছ। এসব ছাড়াও জারুল, সোনালু, শ্বেতকাঞ্চন, মধুমঞ্জরী, কাঠগোলাপ, রক্তপলাশ, কৃষ্ণচূড়া, ঝুমকোজবাসহ অসংখ্য ফুলের গাছ। পাশাপাশি দেশি ফলের গাছেরও কমতি নেই।

সোনা পাহাড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে অবকাশযাপনের ব্যবস্থাও আছে। উদ্যোক্তারা চান, প্রকৃতি সংবেদী ও দরদি মানুষেরা এখানে আসবেন। সোনা পাহাড়ের প্রকৃতির নান্দনিক সান্নিধ্য যেমন উপভোগ করবেন, তেমনি এর সংরক্ষণ প্রক্রিয়া ও বিন্যাসের অভিজ্ঞতাও তাঁরা লাভ করবেন। তাঁদের প্রত্যাশা, যিনি সেখানে যাবেন, তিনিও তাঁর নিজ পরিসরে সেটির প্রয়োগ ও আয়োজনের তাগিদ অনুভব করবেন। নিদেনপক্ষে প্রকৃতি বিপন্ন হয়, এমন আচরণ থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন।

উদ্যোক্তাদের লক্ষ্য মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্মানো—যেকোনো জায়গার নিজস্ব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রেখে এবং প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে নিবাস তৈরি করে জীবনযাপন সম্ভব। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং এর প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তোলা। পরিবেশ ও প্রতিবেশের অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদ, পাহাড়, জলাশয় বাঁচলে মানুষও বাঁচবে—এই বার্তা দেওয়া। এই পৃথিবী কেবল মানুষের নয়, আরও যারা এই পৃথিবীর বাসিন্দা, তাদেরও।

নববর্ষের দিন সন্ধ্যায় সোনা পাহাড় থেকে ফিরতে ফিরতে কী যেন মনের ভেতর বারবার বাজছিল। সেটা কি কোকিলের ডাক, লোকগানের সুর, পাহাড়ি ফুলের ঘ্রাণ, নাকি নিবিড় গাছপালার ছায়া? সব মিলিয়ে মনের ভেতর তৈরি হয়েছিল সোনা পাহাড়ের মায়া।