ঠেলাগাড়ি ঠেলে দুই যুগ ধরে সবজি বিক্রি করছেন তিনি

দুই যুগ ধরে ঠেলাগাড়ি ঠেলে ঘুরে ঘুরে এভাবেই সবজি বিক্রি করছেন চান মতি। গত বৃহস্পতিবার সকালে মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার উত্তর সেওতা এলাকায়ছবি: প্রথম আলো

সরু খালের পাশে পাকা সড়ক। সেই সড়ক ঘেঁষে পাকা ও আধপাকা বাসা। সড়কের এক পাশ ঘেঁষে ঠেলে ঠেলে দুই চাকার ঠেলাগাড়িতে সবজি নিয়ে চলছেন ৬৫ বছর বয়সী এক নারী। ঠেলাগাড়ি ঠেলছেন আর মাঝেমধ্যে হাঁকডাক ছেড়ে বলছেন, ‘সবজি লাগব.., সবজি...?’

কারও সবজি লাগলে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন বাসার বাসিন্দারা। ৩০ জানুয়ারি সকালে মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার উত্তর সেওতা এলাকায় এমন চিত্র দেখা যায়। সবজি বিক্রেতা ওই নারীর নাম চান মতি। তিনি মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার মেহেন্দীবাগ গ্রামের মৃত আফছের আলীর স্ত্রী। দুই যুগ ধরে মানিকগঞ্জ পৌর এলাকার উত্তর সেওতা, গঙ্গাধরপট্টি ও পোড়রা এলাকায় দুই চাকার ঠেলাগাড়ি ঠেলে শাকসবজি বিক্রি করে আসছেন।

সবজি বিক্রির এক ফাঁকে আলাপ হয় চান মতির সঙ্গে। তিনি জানালেন, বাবার অভাবের সংসারে ১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয় তাঁর। দিনমজুর স্বামীর সংসারে এসেও অভাব পিছু ছাড়েনি। দিনমজুরের কাজ করে স্বামীর যা রোজগার হতো, তা দিয়ে টেনেটুনে চলছিল সংসার। এরই মধ্যে দুই ছেলে ও এক ছেলের জন্ম হয়। স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়েন। প্রায় ৪০ বছর আগে স্বামী মারা যান। পরে চান মতি ছোট সন্তানদের নিয়ে এক অবর্ণনীয় কষ্টে পড়েন। খেয়ে না–খেয়ে দিন চলতে থাকে। অন্যের বাড়িতে কাজ করে ও মানুষের সহযোগিতায় চলতে থাকে দিন। এরই মধ্যে তাঁর মাথায় এল বাজার থেকে শাকসবজি কিনে ঘুরে ঘুরে সবজি বিক্রি করবেন। প্রায় ২৫ বছর আগে শুরু করলেন ফেরি করে সবজি বিক্রি। সেই কাজ এখনো করে যাচ্ছেন।

সবজি লাগবে..., সবজি...? আছে টাটকা সবজি...।
চান মতি, সবজি বিক্রেতা নারী

চান মতির দুই ছেলে মো. মিঠু ও মো. রমজান আলী। মিঠু ঝালমুড়ি বিক্রি করেন। বিয়ে করার পর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে ঠাঁই নেন। আর ছোট ছেলে রমজান ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালান। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে মেহেন্দীবাগ গ্রামে পৈতৃক বসতবাড়িতেই আছেন। চান মতির মেয়ে শিরিন আক্তারের বিয়ের পর থেকে স্বামীর বাড়িতে।

চান মতির সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, প্রতিদিন ভোরে জেলা সদরের ভাটবাউর ও জাগীর পাইকার বাজার থেকে শাকসবজি কেনেন। পরে তা ঠেলাগাড়িতে করে জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করেন। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ৫০০ থেকে ৭০০ টাকার সবজি বিক্রি করেন। এতে তাঁর ১০০ থেকে ১৫০ টাকা আয় হয়। এই আয়েই তাঁর নিজের খরচের জোগান হয়। এখন সবজির দাম কম। ফলে তাঁর আয়ও কিছুটা কমেছে।

মেহেন্দীবাগ গ্রামে স্বামীর ছয় শতক বসতভিটায় ছোট ছেলের সংসারে থাকেন চান মতি। স্বাভাবিকভাবে এই বয়সে হেঁটে চলাও কষ্ঠসাধ্য, তার ওপর ঠেলাগাড়ি ঠেলে নিয়ে রাস্তাঘাটে সবজি বিক্রিতে বেশ ধকল যায় চান মতির ওপর। তবুও তিনি কারও কাছে বোঝা হতে চান না। চান মতি বলেন, ‘ছেলেরাই বউ-পোলাপান নিয্যা কষ্টে চলে। তাদের সংসার চালাতেই তারা অস্থির। আমার একটা অসুখ হলে ট্যাহা লাগে। তিন-চার মাস আগে আমার চোখে অপারেশন করতে প্রায় ১৫ হাজার ট্যাহা লাগছে। এই ট্যাহা পোলাপান দিতে পারে নাই। তা ছাড়া নিজের খরচ আছে। কাপড়, তেল, সাবান ও ওষুধ লাগে। নিজে রোজগার করে নিজের খরচ জোগাই।’  

কথায় কথায় এরই মধ্যে সময় গড়িয়েছে বেশ। ঠেলাগাড়ি আবার ঠেলতে শুরু করলেন চান মতি। আর হাঁকডাক ছেড়ে আবার বলতে থাকেন, ‘সবজি লাগবে..., সবজি...? আছে টাটকা সবজি...।’