জন্মনিবন্ধন সনদ নিতে গিয়ে নাকাল মানুষ

তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই অসতর্কভাবে কাজ করায় জন্মনিবন্ধন করার সময় নামের বানানসহ নানা ক্ষেত্রে ভুল হচ্ছে।

গাজীপুর জেলার মানচিত্র

গাজীপুর সিটি করপোরেশনের ভোগড়া এলাকার ফারজানা আক্তার কারখানায় চাকরি জন্য আবেদন করবেন। এ জন্য প্রয়োজন জন্মনিবন্ধন সনদ। তাঁর জন্মনিবন্ধন হয়েছিল, কিন্তু নামের বানানে ভুল থাকায় কোনো কাজ করতে পারছিলেন না। এটি সংশোধনের জন্য দুই মাস আগে স্থানীয় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গেলে তাঁকে একটি আবেদন করতে বলেন। কথামতো আবেদন করেন ফারজানা। এ কাজে মেয়ের হয়ে দৌড়ঝাঁপ করেছেন হানিফ মিয়া।

গত সোমবার দুপুরে মেয়ের সংশোধিত জন্ম সনদ হাতে পেয়েছেন হানিফ। ভোগান্তির কথা জানিয়ে তিনি বলছিলেন, ‘এই কাগজটা করতে গিয়ে আমার জীবন শেষ। কত দিন ধরে যে দৌড়াদৌড়ি করলাম। যাক অবশেষে আল্লাহ মাফ করেছে।’

গাজীপুরে জন্মনিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে এমন ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন অনেকে। সিটি করপোরেশনের নগর ভবনে সপ্তাহের কার্যদিবসের প্রতিদিনই মানুষের ভিড় থাকে। তাঁদের কারও জন্মনিবন্ধন নতুন করতে হবে। কারও সনদে ভুল হয়েছে, তা সংশোধন করতে হবে। আবার অনেকের সনদ অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে না। অসতর্কতা ও কম গুরুত্ব দিয়ে নিবন্ধন কার্যক্রম পরিচালনা করায় বেড়েছে ভুলের সংখ্যাও।

সার্ভার সমস্যার কারণে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। এ বিষয়ে এখানে আমাদের কিছু করার নেই।
রহিমা বেগম, নিবন্ধন সহকারী, গাজীপুর সিটি করপোরেশন

গাজীপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সাল থেকে অনলাইনে নাগরিকদের জন্মনিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়। সরকারি নিয়মে জন্মের ৪৫ দিন পর্যন্ত সম্পূর্ণ বিনামূল্যে নিবন্ধন করা হয়। পাঁচ বছর বয়সীদের ২৫ টাকা, এর বেশি বয়স্কদের নিবন্ধন করতে হলে ৫০ টাকা ফি দিতে হয়।

সরকার নির্ধারিত ফি দিয়ে এসব সেবা দেওয়ার বিধান থাকলেও নানা অজুহাতে অর্থ নেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। কালীগঞ্জ উপজেলার বালিগাঁও গ্রামের মোখলেছা খাতুন বলেন, গত ২১ মে মেয়ে আয়েশা আক্তারের জন্মনিবন্ধন সংশোধনের আবেদন করা হয়। আবেদন করার সময় উপজেলার এক কর্মচারীকে কম্পিউটারে কাজ করার জন্য ২০০ টাকা দিতে হয়েছে। আর গাজীপুর অফিসে গিয়ে আরও একজনকে ৩০০ টাকা দিয়ে সংশোধনের কাজ করেছেন।

গাজীপুরের ৫টি উপজেলার ৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৩টি পৌরসভার ২৭টি ওয়ার্ড, ১টি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও একটি সিটি করপোরেশনের ৫৭টি ওয়ার্ডে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজ করা হয়। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদগুলোয় চেয়ারম্যান, পৌরসভায় মেয়র, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিটি করপোরেশনের প্রতিটি অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা নিবন্ধকারী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

জন্মনিবন্ধনে কোনো ভুল সংশোধন করার ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদগুলোর জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও পৌরসভা, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক সংশোধনকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

জন্মনিবন্ধন–সংক্রান্ত কাজ নিয়ে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আগের রেজিস্ট্রেশন দেখে, তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই অসতর্কভাবে ও দায়িত্বহীনভাবে কাজ করায় জন্মনিবন্ধনের নামের বানানসহ নানা ক্ষেত্রে ভুল হচ্ছে। এতে চলমান ভোটার তালিকায় নিজেদের অন্তর্ভুক্তি, শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র করাসহ বিভিন্ন সেবা ও প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।

গাজীপুরের আউটপাড়া এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানতেন না জন্মনিবন্ধনের সনদে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সনদ একবারে নিতে হয়। নিবন্ধক কার্যালয় থেকে বাধ্যতামূলকভাবে উভয় ভাষায় সনদ দেওয়ার কথা থাকলেও তাঁকে কিছু জানানো হয়নি।

পরে তিনি গত ১ জুন পাড়ার একটি কম্পিউটার কম্পোজের দোকান থেকে আবেদন ফরম পূরণ করে স্থানীয় কাউন্সিলরের কার্যালয়ে এবং পরে নগর ভবনে যান। সেখান থেকে তাঁকে জানানো হয়, আবেদন হয়নি, সার্ভারেও পাওয়া যাচ্ছে না। রফিকুল আবার সেই দোকানে ফেরত গেলে দোকানদার জানান, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধকের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঢুকে সঠিক নিয়মেই আবেদন করা হয়েছে।

রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ওই দোকান থেকে আমি আবার আসি আঞ্চলিক কার্যালয়ে। এবার তারা জানায় সার্ভার ডাউন থাকায় আবেদন দেখতে পারছে না। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকার পর আবেদনটি দেখে আমাকে ডিসি অফিসে যেতে বলা হয়। ডিসি অফিসে যাওয়ার পর জানানো হয়, আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে ঠিকমতো আবেদন পাঠানো হয়নি। আমি তিনবার ডিসি অফিসে গেছি। সেখান থেকে আবার আবার পাঠানো হয়েছে নগর ভবনে।’

এসব অভিযোগের বিষয়ে গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নিবন্ধন সহকারী রহিমা বেগম বলেন, সার্ভার সমস্যার কারণে মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। এ বিষয়ে এখানে তাঁদের কিছু করার নেই। আর গাজীপুর জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার শাখার কর্মকর্তা মো. জাকারিয়া বলেন, কিছু দিন আগে সার্ভারের সমস্যার কারণে অনেক সংশোধনী ঝুলেছিল। এখন সেই সমস্যা নেই। এখন যেকোনো আবেদন তিন কর্মদিবসের মধ্যেই করে করা যাচ্ছে।

জন্মনিবন্ধন ও সংশোধন কাজে অনিয়মের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানান গাজীপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আপনাদের কাছে এমন কোনো অভিযোগ এলে বা কেউ জন্মনিবন্ধন ভোগান্তি পড়ে থাকলে সরাসরি আমার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। আমি তাৎক্ষণিক তা সমাধান করে দেব।’