অভাবকে সঙ্গী করে তাদের এগিয়ে চলা

দরিদ্র পরিবারের মেধাবীদের সাফল্য যেমন গর্বিত করেছে সবাইকে, তেমনি তুলে ধরেছে দুঃসময় পেরিয়ে আলোর পথে এগোনোর গল্প।

কারও বাবা রাজমিস্ত্রির জোগালি, কারও বাবা বর্গাচাষি, আবার কারও বাবার মৃত্যুতে সংসারে নেমে এসেছে অন্ধকার। কেউ হেঁটে ছয় কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে, কেউ টিউশনি করে জোগাড় করেছে পড়াশোনার খরচ। তবু দমে যায়নি তারা। অভাব-অনটন, কষ্টকে সঙ্গী করে এগিয়ে চলেছে তারা।

অধ্যবসায়ের জোরে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে শেরপুরের সুমাইয়া, সুনামগঞ্জের তানজিনা, কক্সবাজারের জান্নাতুল আর গাইবান্ধার জয়িতা। তাদের প্রত্যেকের স্বপ্ন একদিন বড় হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো।

সহযোগিতা পেলে অনেক দূর এগোবে সুমাইয়া

রাজমিস্ত্রির জোগালি বাবা, গৃহিণী মা। সংসারের সম্পদ বলতে শেরপুর সদর উপজেলার ফটিয়ামারি গ্রামের ১০ শতক ভিটায় একটি পুরোনো দোচালা টিনের ঘর। অভাব-অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। তবে সে অভাব দমাতে পারেনি মোছা. সুমাইয়াকে। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় শেরপুরের নকলা উপজেলার কায়দা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

তার বাড়ি শেরপুর সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের ফটিয়ামারি গ্রামে। রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে যা আয় করেন, তা দিয়েই সংসার ও দুই সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালান বাবা সামিদুল হক। মা জেসমিনের দুশ্চিন্তা এখন মেয়েকে কলেজে ভর্তির খরচ জোগানো।

শিক্ষকদের সহযোগিতায় ভালো ফল করতে পেরেছে বলে মনে করে সুমাইয়া। সে বলেন, ‘পড়াশোনার খরচ জোগাতে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের পড়াতাম। আমার স্বপ্ন চিকিৎসক হওয়া। গরিব ও অসহায় মানুষকে বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিতে চাই।’

তিন কিলোমিটার হেঁটে বিদ্যালয়ে যাতায়াত

বর্গাচাষি বাবা বর্ষা এলে মাছ ধরে সংসার চালান। মা গৃহিণী। সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার সাউদপাড়া গ্রামের সেই দরিদ্র পরিবারে জন্ম নিয়েও হাল ছাড়েনি তানজিনা আক্তার তানিয়া। অভাবের কারণে প্রতিদিন তিন কিলোমিটার দূরের বিদ্যালয়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করেছে, তবু এই কষ্টকে সে কখনো বাধা মনে করেনি।

সেই কষ্টের ফলও পেয়েছে তানজিনা আক্তার। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় উপজেলার মহিষখলা উচ্চবিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে সে।

পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তানজিনা সবার বড়। মা রুজিনা আক্তার বলেন, ‘আমরার এক ছেলে ও চাইরজন মাইয়া লইয়া কষ্টের মইধ্যো দিন যাইতাছে। বড় মাইয়াডা ভালা রিজাল করছে। লেহাপড়া কইরা হে ডাক্তার অইতে চায়। কেউ সাহায্যের হাত বাড়াইলে আমরার খুব উপকার অইলয়।’

বাবা আবদুর নূর বলেন, ‘বড় মাইয়াডার স্বপ্ন হে লেথাপড়া কইরা ডাক্তার অইব। আমরার যা ক্ষমতা, এই স্বপ্ন কুনু অবস্থাতেই পূরণ করা যাইতো না।’

তানিয়ার নিজের স্বপ্নও তাই—চিকিৎসক হয়ে গরিব-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল মালেক ফকির বলেন, সুষ্ঠু পরিবেশ পেলে তানিয়া ভবিষ্যতে ভালো কিছু করবে।

সারা দিন বই নিয়ে থাকত জান্নাতুল

ঘরে টেলিভিশন নেই। নেই মুঠোফোন। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে দূরে থাকা পরিবারের মেয়ে জান্নাতুল আদন সারা দিন পড়ে থাকত বই–খাতা নিয়ে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব চার কিলোমিটার। সকালে না খেয়েই হেঁটে হেঁটে স্কুলে চলে যেত, ক্লাস, প্রাইভেট শেষ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আবার পড়তে বসে যেত। ক্ষুধা-দারিদ্র্যকে মোকাবিলা করে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে জান্নাতুল আদন।

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জান্নাতুল কক্সবাজার বায়তুশ শরফ জব্বারিয়া একাডেমি স্কুল অ্যান্ড কলেজে থেকে মানবিক শাখায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে জান্নাতুল আদনের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার ইচ্ছা থাকলেও দারিদ্র্য বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

কক্সবাজার পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়তলীর ইউছুলুঘোনা এলাকায় এক খণ্ড জমিতে জান্নাতুলের ঝুপড়ি ঘর। জান্নাতুল আদন জানায়, ২০১৪ সালে যখন তার বাবার মৃত্যু হয়। তখন পরিবারে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। মৃত্যুর আগপর্যন্ত বাবা বায়তুশ শরফ জামে মসজিদে টানা ২৫ বছর মুয়াজ্জিনের চাকরি করেছেন।

জান্নাতুলের মা ইয়াসমিন জাহান বলেন, ‘কয়েক মাস ধরে বড় দুই ছেলেমেয়ে টিউশনি করে নিজেদের লেখাপড়ার খরচ মেটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। লেখাপড়া খরচ জোগানোর মতো সম্পদ বলতে কিছুই নেই।’

জান্নাতুলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ মো. ছৈয়দ করিম বলেন, জান্নাতুলকে বিনা বেতনে পড়াশোনা ও কোচিং-প্রাইভেটের সুযোগ দেওয়া হয়। অর্থসহায়তা না পেলে মেধাবী মেয়েটির ভবিষ্যৎ মাঝপথে থেমে যেতে পারে।

টিউশনির টাকায় পড়াশোনা

সূর্যোদয়ের আগেই নিজের পড়ালেখা সেরে নিয়েছে। এরপর টিউশনি করিয়ে বিদ্যালয়ের পথ ধরেছে। বেশির ভাগ সময় সকালের নাশতা করা হয়নি। কখনো নিজের টাকায় টিফিন করা হয়নি। বন্ধুদের আনা টিফিন ভাগ্যে জুটেছে। বিকেলে বাড়ি ফিরেও টিউশনি করতে হয়েছে। সহায়তা করতে হয়েছে মায়ের সংসারের কাজেও। এভাবেই লেখাপড়া চালিয়ে এ বছর এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছেন জয়িতা রানী অর্পিতা।

জয়িতা রানীর বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার বোয়ালি ইউনিয়নের উত্তর ফলিয়া গ্রামে। তার বাবা উত্তম কুমার দাস ঝিনাইদহ জেলায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তিনি ২০২২ সালে মারা গেছেন। মা দিতি রানী সরকার গৃহিণী। মা ও ছোট ভাইকে নিয়ে তাদের তিন সদস্যের সংসার।

জয়িতা রানী সাদুল্লাপুর কেএম পাইলট সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ছাত্রী ছিল। মা দিতি রানী সরকার বলেন, ‘মেয়েটা যখন ছোট ক্লাসে ছিল, তখন চিন্তা ছিল না। এখন লেখাপড়ার খরচ নিয়ে চিন্তায় আছি।’

জানতে চাইলে জয়িতা রানী বলেন, ‘আমি লেখাপড়া করে চিকিৎসক হতে চাই। সংসারের হাল ধরতে চাই। মায়ের সংসারের অভাব ঘোচাতে চাই।’

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার, প্রতিনিধি, গাইবান্ধা, ধর্মপাশা, সুনামগঞ্জনালিতাবাড়ী, শেরপুর]