ইউপি চেয়ারম্যান মনিরের মতো হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন অনুসারী জামাল

জামাল হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

গোমতী নদীর দক্ষিণপাড়ে কুমিল্লার দাউদকান্দির গৌরীপুর বাজার। উত্তরপাড়ে তিতাস উপজেলার জিয়ারকান্দি ইউনিয়ন। একসময় দাউদকান্দি উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল জিয়ারকান্দি। ২০০৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তিতাস নতুন উপজেলা হয়। নতুন উপজেলা হলেও জিয়ারকান্দির লোকজনের ব্যবসা-বাণিজ্য গৌরীপুর বাজারে। এখানেই এ ইউনিয়নের বেশির ভাগ মানুষ থাকছেন। গতকাল রোববার রাত সোয়া আটটার দিকে গৌরীপুর পশ্চিম বাজারে খুন হওয়া তিতাস উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জামাল হোসেন ভাড়া বাসায় থাকতেন। গৌরীপুর বাজারে থাই ও গ্লাসের ব্যবসা আছে জামালের। পাশাপাশি তিনি বালু ও পাথরের ব্যবসা করতেন।

২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর সকালে জিয়ারকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মনির হোসাইনকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ওই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। গতকাল নিহত জামাল হোসেন ছিলেন প্রয়াত চেয়ারম্যান মনির হোসেনের অনুসারী।

এ ছাড়া ১৯৯৭ সালের ১ জুলাই সকালে জিয়ারকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান নুরুজ্জামানকে প্রতিপক্ষের লোকজন প্রকাশ্যে গৌরীপুর বাজারে গুলি করে হত্যা করে। এই গৌরীপুর বাজারেই গত ২৬ বছরে দুই চেয়ারম্যানসহ খুন হলেন তিনজন। তাঁরা সবাই তিতাস উপজেলার বাসিন্দা।

জিয়ারকান্দি এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে ইউপি চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামানের ছেলে আবদুল আলিমকে জিয়ারকান্দি গ্রামে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়। ১৯৯৮ সালে নুরুজ্জামানের আরেক ছেলে মো. আলমকে গুম করা হয়। এলাকায় প্রচার রয়েছে, প্রতিপক্ষের লোকজন আলমকে অপহরণ করে। এরপর ঘাতকেরা তাঁর লাশ কেটে টুকরা টুকরা করে নদীতে ফেলে দেয়। এখন পর্যন্ত তাঁর হদিস মেলেনি।

১৯৯৮ সালের ২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নুরুজ্জামানের বড় ভাই ও নুরুজ্জামান হত্যা মামলার বাদী সিরাজুল ইসলামের ছেলে খোকন মিয়াকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের গোমতা এলাকায় ট্রাকচাপা দিয়ে হত্যা করা হয়। নুরুজ্জামান নিহত হওয়ার পর ওই ইউপিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান হন তাঁর ছোট ভাই শফিকুল ইসলাম। ২০১১ সালের ৩ এপ্রিল রাতে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার ঢাকা-গোপালদী সড়কের দক্ষিণপাড়া সেতুসংলগ্ন এলাকায় র‍্যাবের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম।

শফিকুল ইসলামের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বেবী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগের আমলে এই পরিবারের দুজন চেয়ারম্যানকে হত্যা করা হয়। আমার দুই ভাশুরের তিন ছেলেকেও হত্যা করা হয়। আমরা কোনো বিচার পাইনি। জিয়ারকান্দিতে মানুষের মধ্যে হিংসা বেশি। প্রতিহিংসার কারণে এখানে এত খুনোখুনি। এটা বন্ধ হওয়া দরকার।’

সাত বছর আগে খুন হওয়া চেয়ারম্যান মনির হোসাইনের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার বলেন, হত্যাকাণ্ডগুলোর বিচার না হওয়ার কারণে একের পর এক খুনোখুনি হচ্ছে।

আজ সোমবার দুপুরে গৌরীপুর বাজারের অন্তত চারজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক বিরোধ, মাদক ও জুয়া খেলা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঝামেলা হয়। এরপর খুনোখুনি হয়। একজন ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সাত বছর আগে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়া মনির হোসাইনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন জামাল হোসেন। মনিরকে যারা হত্যা করেছে, এই চক্রের লোকজনই জামালকে হত্যা করেছে বলে মনে হয়।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফজল হোসেন বলেন, ‘যুবলীগ নেতা জামাল হত্যাকাণ্ড একটি পরিকল্পিত ঘটনা। এর পেছনে অনেক সমীকরণ আছে। এসব বের করা হবে। আমরা বাজারের বিভিন্ন সিসিটিভির ফুটেজ বের করছি। হত্যার উদ্দেশ্য জানার জন্য তদন্ত চলছে। এখানে অনেকগুলো গ্রুপ আছে। একক কোনো বিষয় এটি নয়। আমরা অপরাধীদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি।’

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ২০১৫ সালের ১৫ মে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুন হন কুমিল্লা উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও তিতাস উপজেলার জগৎপুর গ্রামের ইকবাল হোসেনের ছেলে মাসুম সরকার। ২০১৬ সালের ২৮ মে ইউপি নির্বাচনের দিন প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয় একই উপজেলার বলরামপুর ইউপির চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিনকে। ২০০৭ সালের ২৮ জুলাই নিখোঁজ হন তিতাস উপজেলা শ্রমিক দলের সভাপতি বদিউল আলম ভূঁইয়া। ওই বছরের ৩০ জুলাই দাউদকান্দির ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া গোমতী নদীর কদমতলী এলাকা থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় বদিউলের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

তিতাস থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুধীন চন্দ্র দাস বলেন, তিতাসে রাজনৈতিক নেতারা সম্মিলিতভাবে কাজ না করলে কয়েক দিন পরপর হত্যার ঘটনা ঘটতে থাকবে। অতীতের হত্যাকাণ্ডগুলো পর্যালোচনা করলে সেটি অনুধাবন করা যায়।